তথাকথিত নিরপেক্ষ বিচার যদি শেষ পর্যন্ত অন্যায়কারীকে শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই নিরপেক্ষ বিচার আমাদের কোন কাজে লাগবে? আরও যা লিখলেন উত্তম দেব-
ভারতে দ্রুত বিচার পাওয়া যায় না। বিলম্বে এমনকি অতি বিলম্বেও কটা মামলার শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়? বিলম্বিত বিচার, বিচার না পাওয়ারই শামিল- এই আপ্তবাক্য বহু ব্যবহারে আমরা জীর্ণ করে ফেলেছি কিন্তু তাতে আদালতে ঝুলে থাকা মামলার বোঝা হালকা হয় নি। ‘আদালতে শেষ পর্যন্ত শাস্তি হবে না’- এই ধারণা যেমন অপরাধীদের উৎসাহিত করে তেমনি ন্যায়ের প্রতি নৈরাশ্যবাদী করে তোলে অপরাধের শিকারকে। বলুন তো, দেশের ক’টা মানুষ আদালত সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে?
একটি পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারলাম, দেশের নিম্ন আদালতগুলিতে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ৪ কোটি ৩০ লক্ষ। মোট ঝুলে থাকা মামলার ৮৭.৪ শতাংশই নিম্ন আদালতের। সবকটি হাইকোর্ট মিলে মামলা জমে আছে ৫৯ লক্ষ ৮৭ হাজার ৪৭৭টি। সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা মামলার সংখ্যা ৬ লক্ষ ৯ হাজার। একটি হিসেব বলছে, কলকাতা হাইকোর্টে মামলা ঝুলে আছে ২ লক্ষ ৫ হাজার ৪১৪টি। কলকাতা হাইকোর্টে জমে থাকা মামলার ৪০ শতাংশই দশ বা ততোধিক বছরের পুরোনো। পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত পরিকাঠামোগুলির কী ভঙ্গুর অবস্থা, টাটা ট্রাস্টের ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট-২০২২ তা সামনে এনেছে।
ভারতে দুর্নীতির অভিযোগের বিচার, তাও আবার প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে, পাওয়া কত কঠিন তা জনগণ জানে। রাজ্যে নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের কথাই ধরুন। দুর্নীতির বিষয়টি কে না জানত! গ্রামে গ্রামে এজেন্ট। ব্লকে ব্লকে দালাল। বাড়ি বাড়ি থেকে টাকা তোলা। ইডি-সিবিআই তদন্তের আগে এ’সব ঘটনা কি আমরা জানতাম না? কীভাবে ‘ওএমআর শিট’ ভরাট করা হয়, সেই গল্প বাজারে কি আজ ছড়িয়েছে? কোন পদের জন্য কত টাকা নজরানা। কোন চাকরির জন্য কাকে টাকা দিলে কাজ হবে। কলকাতায় কার খায়েশ কত, এ’সব আমরা সবই জানতাম। যাকে বলে ‘ওপেন সিক্রেট’, গুপ্ত বিষয় কিন্তু সমাজে চর্চিত। যাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ, তারা কত শক্তিশালী। তাদের হাত কত লম্বা। দুর্বলের প্রতিবাদ তাদের প্রভাবের সামনে কীভাবে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে পারে, এ’সব উপলব্ধি করার জন্য জেমস বন্ড হওয়ার দরকার পড়ে না। মোদ্দা কথা- জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘মিশনারি জিল’ নিয়ে এজলাসে না বসতেন; আজকে যারা জেলে, তারা জেলের বাইরে স্বরাজ্যে স্বরাট হয়েই বিরাজ করত। কেউ তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারত না।
নিরপেক্ষ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল পক্ষপাতশূন্য। কিন্তু অভিধানের বাইরে নিরপেক্ষ থাকার অর্থ রুদ্রনীল ঘোষের ‘দাদা আমি সাতেপাঁচে থাকি না’ কবিতায় বলা আছে। সত্যি করে বলুন তো, পশ্চিমবঙ্গে ছেলেমেয়েদের চাকরি নিয়ে যা যা ঘটে গেছে, তাতে পক্ষপাতশূন্য থাকার কোনও সুযোগ আছে? বিচার শব্দের অপর অর্থ ন্যায়। ন্যায়ই বিচারের অন্তর্নিহিত বাণী। এ’জন্য বিচার শব্দের আগে ন্যায় বসে- বলা হয় ‘ন্যায়বিচার’। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কখন কাঁদে? যখন বিচারপ্রার্থী ন্যায় প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। তথাকথিত নিরপেক্ষ বিচার যদি শেষ পর্যন্ত অন্যায়কারীকে শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই নিরপেক্ষ বিচার আমাদের কোন কাজে লাগবে?
নিয়োগ দুর্নীতি মামলার যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তার ফল শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, আমরা জানি না। দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা সাজা পাবে নাকি বেকসুর বেরিয়ে আসবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু একটা মানুষ ‘এর শেষ দেখে ছাড়ব’ মানসিকতা নিয়ে রোজ বিচারালয়ে যাচ্ছেন বলেই দুর্নীতির পাহাড়টা শেষ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। পাহাড় ভেঙে ফেলার সাধ্য তাঁর একার নেই। কিন্তু তিনি যা করে দিয়ে যাচ্ছেন, আদালতের পরবর্তী ধাপগুলিতে তা অগ্রাহ্য করাও সহজ নয়। সমসাময়িক সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার বহুদিন পরেও জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে রাখবে ভাবীকালের ইতিহাস।
কোনও কোনও দলের প্রগল্ভ মুখপাত্রের জ্বালার কারণটাও আমরা বুঝি।
Feature Image is representational and collected.