পলিটিক্যাল ডেস্ক: বুথ ফেরত সমীক্ষাতে আভাস ছিলই। তবে জেডিইউ-বিজেপি জোটের যে এমন ভূমিধ্বস বিজয় হবে, তা দেশের অতি বড়পোলস্টারও আন্দাজ করতে পারেন নি। যদিও ঝানু রাজনীতিবিদ ও ইলেকশন ম্যানেজমেন্টের মহাগুরু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রচারপর্বেই দাবি করেছিলেন, দুশোর বেশি আসন নিয়ে বিহারে জেডিইউ-বিজেপি জোটের কামব্যাক শুধু সময়ের অপেক্ষা। শাহবাক্য বিফলে যায় নি। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় জেডিইউ-বিজেপি জোট ২০২। যাকে বলে কল্পনাতীত শোচনীয় পরাজয়, শুক্রবার তাই বরণ করে নিতে হল মহাগোঠবন্ধনকে। লালুপুত্র তেজস্বী যাদব কোনও রকমে তাঁর নিজের আসনটি রক্ষা করতে পারলেও দল ও জোটকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন নি।

মহাগোঠবন্ধনে আরজেডি বাদে বাকি দলগুলির এককথায় ল্যাজেগোবরে দশা! আরজেডির ঝুলিতে মাত্র ২৬ আসন। গত বিধানসভা (২০২০) ভোটের ফার্স্টবয় নেমে গেছে তিন নম্বরে। কংগ্রেস সাকুল্যে ৬। সিপিআইএমএল-লিবারেশন ২। সিপিএম জিতেছে মাত্র একটি আসনে। বিহারে এক সময়ের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি সিপিআই শূন্য! তুলনায় একা লড়ে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির ‘এআইমিম’-এর রেজাল্ট খারাপ নয়। মিম জিতেছে ৫টি আসন।
ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য জানাচ্ছে, বিজেপি ৭৭টি আসন জিতে গেছে। ১২টিতে এগিয়ে। কয়েকটি আসনে ‘কাটে কা টক্কর’ চলছে। জেজিইউ ৬২টি আসন জিতে গেছে। ২৩টিতে এগিয়ে। রামবিলাসপুত্র চিরাগ পাসোয়ানের দল লোকজন শক্তি ১৫টি জিতে নিয়েছে। ৪টিতে এগিয়ে। বিজেপি ও নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড)- দুই দলই ১০১টি করে আসনে লড়েছিল। বিজেপি ১০১-এ ৯০। জেডিইউ ১০১-এ ৮৫। জোটের দুই শরিকের স্ট্রাইক রেটই যে মারাত্মক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিহার বিধানসভার ইতিহাসে সেরা ফল গেরুয়া শিবিরের। বিহারে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বিজেপি।
মাঝে ৯ মাস বাদ দিলে ২০০৫ থেকে বিহারের মসনদে টানা নীতীশ কুমার। ভারতের রাজনীতিতে মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল পলিটিশিয়ান। সবথেকে সৌভাগ্যবানও। এক বছরে তিনবার জোট পাল্টানোর রেকর্ডও আছে নীতীশের! ‘পল্টুরাম’ উপাধি পেয়েছেন কিন্তু কুর্শি হাতছাড়া হয় নি। কুর্শি বাঁচানোর জন্যই রাতারাতি জোট পাল্টান নীতীশ এবং কুর্শি শেষ পর্যন্ত বাঁচেও। ৭৪ বছরের নীতীশ কুমারের রাজনীতিতে যোগদান ছাত্র বয়সে, সত্তরের দশকে জয়প্রকাশ নারায়ণের ভ্রষ্টাচার বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে। লালুপ্রসাদ যাদব, শরদ যাদব ছিলেন নীতীশের সতীর্থ। কালক্রমে বিহারের রাজনীতিতে কুড়মি নীতীশ কুমারই হয়ে ওঠেন যাদব লালুপ্রসাদের এক নম্বর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী।

২০ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াকে মোকাবিলা করে দশমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে চলা রাজনীতিতে সোজা কথা নয়। একটা সময় দেশের সবথেকে পিছিয়ে পড়া রাজ্য বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমার ছিলেন সুশাসনের প্রতীক। লালু-রাবড়ির জঙ্গল রাজে অতিষ্ঠ হয়ে নীতীশ কুমারকে ক্ষমতায় এনেছিলেন বিহারের জনগণ। মানুষের প্রত্যাশার অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছিলেন বলে বারে বারে নীতীশকে তখত ফিরিয়ে দিয়েছেন জনতা জনার্দন। বয়সের ভারে শরীর নড়বড়ে হয়েছে। মুখ ফসকে এমন কথা বলে ফেলেন যে বিতর্কের ঝড় ওঠে। প্রশাসনের উপরেও আর আগের মতো নিয়ন্ত্রণ নেই। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগের তালিকাটাও কম লম্বা নয়। কিন্তু তারপরেও বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে নীতিশের ফেরাটা অসাধারণ!
২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনে জেডিইউ ১১৫ আসনে প্রার্থী দিয়ে জিতেছিল মাত্র ৪৩টি আসন। নীতিশের দলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৫.৩৯ শতাংশ। শরিক বিজেপি ১১০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জয়লাভ করেছিল ৭৪টি আসনে। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৯.৪৬ শতাংশ। পাঁচ বছর পরে ১৯.১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জেডিইউর আসন ৮৫। ৩.৮ শতাংশ ভোট বৃদ্ধির সুবাদে ৪২টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে জেডিইউ। এবার বিজেপির আসন বেড়ে হয়েছে ৯০। প্রাপ্ত ভোট ২০.২৩ শতাংশ। বিজেপির বেড়েছে ১৬টি আসন ও ০.৭৭ শতাংশ ভোট।
আরও পড়ুন-
- বিহার ভোট: মহাগোঠবন্ধনের মহা বিপর্যয়, নরেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে নীতিশের ক্ষমতায় ফেরাটা অসাধারণ!
- জেলে গিয়ে দুই কানই কাটা গেছে, ফিরে এসে পার্থ তাই এতটা নির্লজ্জ
- ফাঁস ফরিদাবাদ মডিউল, হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে চার চিকিৎসকের জিহাদ!
- বড় জঙ্গি হামলার ষড়যন্ত্র ভেস্তে দিল দেশের নিরাপত্তা বাহিনী, অথচ কুৎসিত সমালোচনায় মেতে বিরোধীরা!
- ২,৯০০ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার ও দিল্লিতে গাড়িতে বিস্ফোরণ! তদন্তে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যোগসূত্র
কী কারণে বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে অসাধ্যসাধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নীতীশ কুমারের সরকারের বিরুদ্ধে লোকের অনেক অভিযোগ কিন্তু ব্যক্তি নীতীশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারে নি কেউ। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেও ভ্রষ্টাচারের বড় অভিযোগ বিরোধীরা তুলতে ব্যর্থ। ভ্রষ্টাচার ও গুন্ডারাজ- এই দুই কারণেই কুখ্যাত লালু-রাবড়ির আমল। লালু নিজে চারা ঘোটালা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী; দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খেটে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারটুকু পর্যন্ত খুইয়েছেন। নীতীশের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক, লালুপ্রসাদ যাদবের জঙ্গলরাজের তিক্ত স্মৃতি বিহারের মানুষ এখনও ভোলে নি।
পঁচিশের বিহার নির্বাচনে মহিলারা ভোট দিয়েছেন ঢেলে এবং তার সিংহভাগ গিয়েছে জেডিইউ-বিজেপির ঘরে। মহিলা ভোটারদের ভোটদানের হার গতবারের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। এবারে যত পুরুষ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছেন, মহিলা ভোটারেরা দাঁড়িয়েছেন তার থেকে ৯ শতাংশ বেশি। মহিলারাই যে ঢেলে ভোট দিয়ে জেডিইউ-বিজেপি জোটকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মহিলাদের মন জয়ে নীতিশের রসায়নটা কী? প্রথমত রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে তার সবথেকে বড় শিকার হন নারীরা। লালুপ্রসাদের জঙ্গলরাজ ফিরিয়ে আনতে চান নি বিহারের মহিলা সমাজ। দ্বিতীয় বড় কারণ, নীতীশের সরকারের ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’। এটাকে শেষ বাজারে নীতীশ কুমারের ধামাকা বলা চলে। বিহারের ১ কোটি ২১ লক্ষ মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ১০ হাজার টাকা করে পৌঁছে গিয়েছিল ভোটের সূচি ঘোষণার দিন কয়েক আগেই। ভোটের আগে নীতীশ এও ঘোষণা করেছিলেন, বিহারের বাসিন্দা এমন মহিলা চাকরিপ্রার্থীদের জন্য রাজ্য সরকারের সমস্ত ধরনের পদে থাকবে ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ। দুই চালেই রাজ্যের মহিলা ভোটারদের মন জিতে নিয়েছেন ঝানু রাজনীতিবিদ নীতীশ কুমার।