ওয়াশিকুর রহমান শুভ্র: বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় কত বড় বিপদের মধ্যে আছে, তার হাতেগরম প্রমাণ গাজিপুরের অপহরণ নাটক। গাজিপুরের টঙ্গীর টিএন্ডটি এলাকার বিটিসিএল জামে মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ মিয়াজী ৬০ বছরের বৃদ্ধ। তাঁকে ইসকন অপহরণ করে ভারতে পাচার করার পরিকল্পনা করেছিল- এই অভিযোগে দিন কয়েক আগেও উত্তাল ছিল বাংলাদেশ। ঢাকা সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল পর্যন্ত করেছে ছাত্ররা। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে, এই অপহরণকান্ড সাজানো নাটক।
মঙ্গলবার দুপুরে গাজিপুর মেট্রোপলিটন আদালত-৪-এর বিচারক যুবায়ের রশিদের কাছে নিজের মুখে স্বীকারোক্তি দেন মুফতি মোহেববুল্লাহ। আদালতের কাছে মোহেববুল্লাহ স্বীকার করেছেন, “আমাকে কেউ অপহরণ করে নি। স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিলাম আমি”। বিচারকের নির্দেশে পুলিশ এই মিথ্যেবাদী ইমামকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেয়। অথচ অপহরণের নাটক সাজিয়ে শুধু ইসকনের সদস্যদেরই নয় দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো উচিত ছিল প্রশাসনের। সবথেকে বড় প্রশ্ন হল, মোহেববুল্লাহ নিজের বুদ্ধিতে অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন নাকি কেউ বা কোনও একটি মহল তাঁকে এই কাজ করতে প্ররোচিত করেছে?
জানা গেছে মসজিদে নামাজের জামাতে ইসকনের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিষোদ্গার করেন মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ। বাংলাদেশের এখন মোহেববুল্লাহর মতো ইমাম একজন-দু’জন নয়। আরও অনেকেই আছেন, যাদের কাজ মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে মুসুল্লিদের সামনে ইসকনকে টার্গেট করে উস্কানিমূলক ভাষণ দেওয়া। মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ নিজের মুখে যে অভিযোগগুলি করেছিলেন তার অভিঘাতে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যেতে পারত, তা কি আন্দাজ করতে পারছে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসন? মোহেববুল্লাহকে শুধু গাজিপুর থেকে অপহরণ করে পঞ্চগড়ে নিয়ে যাওয়াই নয়, তাঁর উপর অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছিল। জোর করে তাঁর সুন্নতি দাড়ি কেটে দেওয়া এমনকি তাঁকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে; এই কথাও মোহেববুল্লাহর মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে আতাউর রহমান বিক্রমপুরীর মতো গোঁড়া ইসলামপন্থী।
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আতাউর রহমান বিক্রমপুরী শেখ হাসিনার আমলে জেলে ছিল। ইউনূসের আমলে খালাস পাওয়ায় পর বিক্রমপুরীর মিশন হয়েছে মুসলিম মেয়েদের ‘ভাগোয়া লাভ ট্র্যাপ’ বা গেরুয়া প্রেমের ফাঁদ থেকে রক্ষা করা ও ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে মুসলমানদের তাতিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের হিন্দু ছেলেরা নাকি ভাগোয়া লাভ ট্র্যাপে ফেলে প্রতিদিন শত শত মুসলিম মেয়েকে ধর্মান্তরিত করছে, এমন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে বিক্রমপুরীর টিম। হিন্দু ছেলেরা মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করে ভারতে পাচার করছে- এই মারাত্মক স্পর্শকাতর অভিযোগ তুলে সামাজিক মাধ্যমে রোজই ঝড় তুলছে আতাউর রহমান বিক্রমপুরী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
অপহরণ নাটকে প্রভাবিত হয়ে ইসকনের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিল মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও
গাজিপুরের টঙ্গীর টিএন্ডটি এলাকার বিটিসিএল জামে মসজিদের ইসকন বিরোধী খতিব মোহেববুল্লাহকে দিয়ে অপহরণের প্লট সাজানোর পিছনে আতাউর রহমান বিক্রমপুরীর হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। অপহরণের নাটক সাজিয়ে দেশে দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে বিক্রমপুরীকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন। সবথেকে আশঙ্কার কথা, ইউনূস জামানায় বাংলাদেশের মূল ধারার প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলিকেও বিক্রমপুরীদের অপপ্রচারে প্রভাবিত হতে দেখা যাচ্ছে।
গাজিপুরের মসজিদের ইমাম অপহরণের খবর ফলাও করে প্রচার করেছে বাংলাদেশের প্রায় সবকটি দৈনিক সংবাদপত্র ও নিউজ চ্যানেল। কট্টর ইসলামপন্থীদের সুরে সুর মিলিয়ে ইসকনকে জঙ্গি ও রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনের তকমা লাগিয়ে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন বাংলাদেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, যাঁদের মধ্যে দুই বড় দল বিএনপি-জামাতেরও কেউ কেউ আছেন। এমনকি যাঁরা নিজেদের মডারেট মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন, এমন বুদ্ধিজীবীরাও খতিব অপহরণের নাটক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি তুলে ফেলেছিলেন। ২০২৪-এর ৫ অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশের ৮ শতাংশ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এমনিতেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার উপর যদি একটি সংগঠিত মহল পরিকল্পনামাফিক হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সারবত্তাহীন স্পর্শকাতর অভিযোগ তুলে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে প্ররোচিত করতেই থাকে, তবে তো ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসে থেকেও আতঙ্ক দূর হবে না হিন্দুদের।
খতিব মোহেববুল্লাহর ছেলেকে কেন গ্রেফতার করা হবে না?
গাজিপুর মেট্রোপলিটন পুলিশকে ধন্যবাদ যে তারা দ্রুত মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহর অপহরণকান্ডের তদন্ত শেষ করে সত্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছে। এই ঘটনায় পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছিল তাতে যে কোনও মুহূর্তে ইসকনের সদস্য এমনকি ইসকনের সঙ্গে সম্পর্কহীন যে কোনও হিন্দু গণরোষের শিকার হয়ে খুন হয়ে যেতে পারত। গাজিপুরের খতিব মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহর ছেলে প্রকাশ্য রাস্তায় শত শত লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে ধরে ধরে মালাউনদের নিজের হাতে জবাই করার হুমকি দিয়েছিল। কেন তাকে গ্রেফতার করা হবে না? ভবিষ্যতে যাতে এই ধরণের স্ক্রিপ্ট রচনা করে কেউ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলতে না পারে, তার জন্য অপহরণ নাটকের পেছনের সকল মাথাদের খুঁজে বের করে জেলে ঢোকানো কি জরুরি নয়?
Feature graphic is representational and designed by NNDC.