৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪: ভারতের ইতিহাসে কলঙ্কিত দিন, ইন্দিরা হত্যা আর তার বদলা নিতে ৩,০০০ মানুষকে খুন!

৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪: ভারতের ইতিহাসে কলঙ্কিত দিন, ইন্দিরা হত্যা আর তার বদলা নিতে ৩,০০০ মানুষকে খুন!


দেহরক্ষীদের গুলিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হ‌ওয়ার খবর সংবাদপত্রে।

সাড়ে নটার মধ্যে ‘এইমস’-এ নিয়ে যাওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীকে। চিকিৎসকদের কিছুই করার ছিল না। ইন্দিরার দেহকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ৩০টি বুলেট। ২৩টি গুলি ইন্দিরার দেহকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়, সাতটি ভেতরে রয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধীকে বলা হত প্রিয়দর্শিনী। প্রিয়দর্শিনীর মুখটিই শুধু অক্ষত থাকে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর দেহে গুলিবর্ষণের পরেই সত‌ওয়ান্ত ও বিয়ন্ত হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাকি নিরাপত্তাকর্মীরা দু’জনকে বন্দি করে একটি ঘরে আটকে রাখেন। যদিও ২৫ বছর বয়সী বিয়ন্ত সিংকে সেই ঘরেই এক পুলিশ আধিকারিক গুলি করে মারেন। কেহর সিং নামে আরও এক শিখ ইন্দিরা হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কেহর সম্পর্কে ছিলেন বিয়ন্ত সিংয়ের কাকা। ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি ভোরে তিহাড় জেলে সত‌ওয়ান্ত সিং ও কেহর সিংয়ের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়।

শক্তিস্থলে ইন্দিরা গান্ধীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। ইন্দিরার মৃত্যুর খবরে দিল্লিতে শিখ নিধন শুরু হয়ে যায়। ফাইল ফটো

৩১ অক্টোবর দুপুর ২টো বেজে ২০ মিনিট নাগাদ ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। এরপর সেই অভিশপ্ত দিনের পড়ন্ত বিকেল থেকে দিল্লিতে যা ঘটতে শুরু করল, তা আরও ভয়াবহ ও কলঙ্কজনক। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারীরা ধর্মীয় পরিচয়ে শিখ, এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল দিল্লি নগরীতে। সন্ধ্যার পর প্রতিশোধে উন্মত্ত জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজধানীর শিখ মহল্লাগুলির উপর। তখন দিল্লি ছিল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। দিল্লির কংগ্রেস নেতারা হিংস্র জনতা ও দলের মারমুখী সমর্থকদের নিরস্ত করার কোন‌ও চেষ্টা তো করেনই নি, উল্টো শিখ নিধনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।

জগদীশ টাইটলার, এইচ কে এল ভগতের মতো দিল্লি কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতারা শিখ বিরোধী দাঙ্গায় সরাসরি ইন্ধন জুগিয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ। এইচ কে এল ভগত তখন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী। দুষ্কৃতীদের টাকা, মদ ও অস্ত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ভগত। সাংসদ সজ্জন কুমার ও শ্রমিক নেতা ললিত মাকেনের ভূমিকা আরও ন্যক্কারজনক। এরা দু’জন রাস্তায় নেমে দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেন। ৩১ অক্টোবর রাতে দিল্লিতে প্রশাসন বলে কিছু ছিল না। ইন্দিরার মৃত্যুতে শোকে উন্মত্ত কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এদের সঙ্গে জুটেছিল দিল্লির যত দাগি দুষ্কৃতী-অপরাধী ও সুযোগসন্ধানী জনতা। তাদের মুখে ‘খুন কা বদলা খুনের’ স্লোগান। হাতে লোহার রড, লাঠি, তরোয়াল, চাকু, পেট্রোল-কেরোসিনের জার। কার‌ও কার‌ও হাতে পেট্রোল বোমা, অ্যাসিডের বোতল।

ইন্দিরার মৃত্যুর জেরে দিল্লিতে দাঙ্গা। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে শিখদের বাড়ি। ফাইল ফটো

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা, সাহস ও প্রস্তুতি- কোন‌ওটাই সেই রাতে ছিল না দিল্লি পুলিশের। উল্টে পুলিশ বহু জায়গায় দাঙ্গাকারীদের মদত দিয়েছে এমন অভিযোগ আক্রান্তদের তরফ থেকে উঠেছে। এমনকি দিল্লির অনেক জেলখানা, সাবজেল ও থানার লক‌আপ খুলে খুনখারাবিতে পাকাহাত দুষ্কৃতীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দাঙ্গায় অংশ নেওয়ার জন্য। দাঙ্গায় সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রাজধানীর সুলতানপুরী, মঙ্গলপুরী, ত্রিলোকপুরী ও ট্র্যান্স-যমুনা এলাকার মতো শিখ সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল। শিখদের বাড়িঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে অবাধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। ঘরে ঘরে ঢুকে পুরুষদের হত্যা করা হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ। পথচলতি শিখেরা উন্মত্ত জনতার হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। বাস ও অন্যান্য যানবাহন থামিয়ে নিরস্ত্র, নিরপরাধ শিখদের হত্যা করেছে দাঙ্গাকারীরা। দিল্লির কাছে ট্রেন থামিয়েও শিখ যাত্রীদের হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

শেষ শয্যায় ইন্দিরা। মায়ের নিথর দেহের পাশে রাজীব গান্ধী। ফাইল ফটো

মায়ের মৃত্যুর খবরে কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরে ৩১ অক্টোবর রাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন রাজীব গান্ধী। রাজীব দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পরেও দাঙ্গা থামে নি। বরং রাতের মধ্যেই দেশের অন্যত্র অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। ৩ নভেম্বরের আগে দিল্লির আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে নি হতবিহ্বল প্রশাসন। চারদিন পেরিয়ে যায় উপদ্রুত অঞ্চলগুলিতে সেনা মোতায়েন করতে। রাজীব গান্ধী বলেছিলেন, “যখন একটি বড় গাছের পতন হয়, তখন চারপাশের মাটি কেঁপে ওঠে।” যে দাঙ্গায় দেশের রাজধানীতে শুধু সরকারি হিসেবেই প্রায় ৩,০০০ মানুষ নিহত (৮,০০০-১৭,০০০ বেসরকারি মতে), অসংখ্য আহত, বহু নারী ধর্ষিত, বেলাগাম লুটপাট-আগুন ও ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত, সেই দাঙ্গাকে এইভাবে কার্যত বৈধতাই দিয়েছিলেন ইন্দিরাপুত্র।

পরবর্তীকালে সিবিআই তদন্ত সহ একাধিক অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে, ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে শুরু হ‌ওয়া শিখ বিরোধী দাঙ্গা নিছক শোকে অন্ধ জনতার প্রতিশোধ ছিল না বরং তা ছিল পরিকল্পিত গণহত্যা ও লুন্ঠন। দিল্লির ছোটবড় বহু কংগ্রেস নেতা শিখ বিরোধী দাঙ্গার পর রাতারাতি বড়লোক হয়ে যান। দাঙ্গাপীড়িতরা সুবিচার পান নি। ঘটনার ৪১ বছর পরেও আদালতে একাধিক মামলা বিচারাধীন। প্রাক্তন সাংসদ সজ্জন কুমার ছাড়া দাঙ্গায় জড়িত আর কোনও বড় নেতার সাজা হয় নি। দু’জন শিখকে হত্যার অপরাধে যশপাল সিং নামে একজনকে মৃত্যুদণ্ড ও যশপালের এক সঙ্গী নরেশ শেহরাওয়াতকে ২০২১ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে দিল্লির একটি নিম্ন আদালত।

চুরাশির দাঙ্গার জেরে দিল্লির শিখ সম্প্রদায়ের আস্থা হারায় কংগ্রেস। এখনও পর্যন্ত যা পুনরুদ্ধার করতে পারে নি দলটি।

Feature graphic is representational and designed by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *