আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কাতারের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষ বিরতি চুক্তি এখনও পর্যন্ত কার্যকর থাকলেও যে কোনও মুহূর্তে ফের পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয়ে যেতে পারে বলে আন্তর্জাতিক মহলের আশঙ্কা। পাকিস্তানকে বিশ্বাস করছে না আফগানিস্তানও। চুক্তির প্রতি পাকিস্তানের দায়বদ্ধতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মৌলভি মহম্মদ ইয়াকুব মুজাহিদ আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস নেই। আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে সংঘর্ষ বিরতি কার্যকর রাখার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে।”
রসদ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যে তালিবানকে কাবুলের মসনদে বসিয়েছে পাকিস্তান সেই তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে এখন ইসলামবাদের শাসকদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই। ডুরান্ড লাইনকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ অনেক দিনের। ‘তেহরিক-ই-তালিবান, পাকিস্তান’-এর হামলায় ব্যতিব্যস্ত পাকিস্তানের অভিযোগ, এদের মদত দিচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির ঘাঁটি ভাঙতে গিয়ে তালিবানের সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে শাহবাজ শরীফের সরকার। আফগানিস্তনের অভিযোগ, পাকিস্তানের বিমান ও ড্রোন হামলায় অনেক নিরীহ অসামরিক জনগণের মৃত্যু হয়েছে। পাক বিমান বাহিনীর বোমায় আফগানিস্তানের ক্রিকেট দলের তিন খেলোয়াড় নিহত হওয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিদেশীয় সিরিজ বাতিল করে দিয়েছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড।

আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ভারতের দিকে আঙুল তুলেছে ইসলামাবাদ। ভারতের ইন্ধনেই নাকি কাবুলের তালিবান সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টিটিপিকে লেলিয়ে দিয়ে এই সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিদ্রোহীদের সামাল দিতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দিশেহারা পাকিস্তান। পাকিস্তানের বহু পুরোনো অভিযোগ, এই দুই প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছে দিল্লি। তবে পাক-আফগান সংঘাতে ভারত কোনোভাবেই জড়িত নয় বলে এবার সরাসরি জানিয়ে দিল তালিবান সরকার। পাকিস্তানের অভিযোগ, তাদের পশ্চিম সীমান্তে আফগানিস্তানের মাধ্যমে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে ভারত। মঙ্গলবার আল-জাজিরার সামনে এই অভিযোগ খারিজ করে দিলেন আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মৌলভি মহম্মদ ইয়াকুব মুজাহিদ। মুজাহিদ বলেন, পাকিস্তানের অভিযোগ ভিত্তিহীন। পাক-আফগান সাম্প্রতিক সংঘাতের নেপথ্যে ভারতের কোনও ভূমিকা নেই। ইসলামাবাদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণেই রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত।”
তবে পাকিস্তানের গোঁসা হলেও তারা নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির লক্ষ্যে আরও এগিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন তালিবান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ২০২১-এর অগাস্টে তালিবানরা কাবুল দখল করার পর দূতাবাস ফাঁকা করে চলে এসেছিলেন ভারতের কূটনীতিকরা। ইসলামাবাদ তখন মনে করেছিল, তালিবানের সৌজন্যে এতদিনে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ বন্ধুত্বের সম্পর্কের অবসান ঘটল। তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মোল্লা মহম্মদ ওমরের পুত্রই বর্তমান তালিবান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মোল্লা ওমরের সেই পুত্র মৌলভি মহম্মদ ইয়াকুব মুজাহিদ আজ বলছেন, “ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করা হবে। আমরা আফগানরা স্বাধীনচেতা জাতি। কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আমরা চলি না। আমাদের জন্য যেটা ভাল মনে হবে, আমরা সেটা করব। জাতীয় স্বার্থেই ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা উচিত হবে বলে আমরা মনে করছি।”
ঘটনা হল, কাবুলের ক্ষমতায় আসার পর ইসলামাবাদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব যত বেড়েছে, নয়াদিল্লির সঙ্গে তিক্ততা দূর করে সম্পর্ক আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে ততই তৎপর হয়েছে তালিবান। পাকিস্তানকে কোনঠাসা করতে তালিবানের বাড়িয়ে দেওয়া বন্ধুত্বের হাতকে সামনে টেনে না নেওয়ায় কোনও কারণ খুঁজে পায় নি সাউথ ব্লক। সাত দিনের ভারত সফর শেষ করে সদ্যই দেশে ফিরেছেন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। গত ৯ অক্টোবর মুত্তাকির ভারত সফর শুরুর দিনেই কাবুলে বিমান হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান। মুত্তাকি যতদিন ভারতে ছিলেন, ততদিন আফগানিস্তানে হামলা বন্ধ করে নি পাকিস্তান, জবাব দিয়েছে আফগানিস্তানও।

আফগানিস্তানের পরিকাঠামো উন্নয়নে ভারতীয় বিনিয়োগ থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনে ভারতের সহযোগিতা- কোনও কিছুতেই যে তাদের আর আপত্তি নেই, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে তা জানিয়ে দিয়েছেন আমির খান মুত্তাকি। ভারত সরকারও আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছে, দ্রুতই কাবুলের ভারতীয় দূতাবাস আগর মতোই পুরোদস্তুর চালু করা হবে। দুই দেশের মধ্যে ফের সরাসরি বিমান যোগাযোগের ব্যবস্থা পাকা করেই দিল্লি ছেড়েছেন তালিবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এমনকি তালিবান কাবুল দখল করার পর আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শিখ ও হিন্দুদের আবার আফগানিস্তানে ফিরে গিয়ে বসবাস ও ব্যবসা শুরু করার আবেদন জানিয়েছেন মুত্তাকি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী মৌলভি মহম্মদ ইয়াকুব মুজাহিদ- তালিবান সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার জোরালো বার্তা দিলেন। এই ঘটনা তালিবানের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী হাক্কানি নেটওয়ার্কের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে যাওয়ার প্রমাণ বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। মোল্লা ওমর পুত্র ইয়াকুব, আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হাসান আখুন্দ, উপপ্রধানমন্ত্রী মৌলানা বরাদর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি তালিবানের ভেতরে ঘোরতর পাকিস্তান বিরোধী বলে জানা গেছে। তালিবান সরকারের উচ্চ পদাধিকারীদের মধ্যে একমাত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজউদ্দিন হাক্কানিই পাকিস্তানপন্থী। পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের জেরে সরকারের ভেতর সিরাজউদ্দিন হাক্কানি আরও কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
Feature Image- NNDC.