কে হবেন তাঁর উত্তরসূরী? বাছাই পদ্ধতি স্পষ্ট করে চিনকে নাক না গলানোর বার্তা দিলেন দালাই লামা

কে হবেন তাঁর উত্তরসূরী? বাছাই পদ্ধতি স্পষ্ট করে চিনকে নাক না গলানোর বার্তা দিলেন দালাই লামা


তিব্বতিরা চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তাদের নির্মমভাবে দমন করে চেয়ারম্যান মাও দেজংয়ের সরকার। ১৯৫৯ সালে ৮৭ হাজার তিব্বতিকে হত্যা করে পিএল‌এ। তিব্বতের রাজধানী লাসার রাজপথ রক্তে ভেসে যায়। তিব্বতিদের ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রীয় প্রধান চতুর্দশ দালাই লামাকে ধরতে পারলেই খুন করার নির্দেশ দিতেন মাও। ১৯৫৯ সালের ১৭ মার্চ লাসা থেকে পালিয়ে গোপনে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন দালাই লামা। সঙ্গে ৭০ জন অনুগামী। তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ। ১৫ দিনের দুঃসাহসিক অভিযান শেষে ১৯৫৯ সালের ৩১ মার্চ ভারতের অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ে এসে পৌঁছান চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো।

জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে দালাই লামা। আশ্রয় নেওয়ার পর ভারতেই ৬৬টা বসন্ত কাটিয়ে দিলেন তেনজিং গ্যাৎসো। আর্কাইভাল ছবি

শরণাগতকে আশ্রয় দেওয়া সনাতন ভারতের ঐতিহ্য। চিনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই দালাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন প্রধানমন্ত্রী জ‌ওহরলাল নেহেরু। ৬৬ টা বসন্ত ভারতেই কাটিয়ে দিলেন দালাই লামা। তিব্বতের সঙ্গে ভারতের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ অতি প্রাচীন কাল থেকেই। সেই সপ্তম শতাব্দীতেই তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা। অষ্টম শতাব্দীতে ভারত থেকে তিব্বতে গিয়েছেন শান্তি রক্ষিত, পদ্ম সম্ভব সহ অনেক বিশিষ্ট বৌদ্ধ আচার্য। ভারতের নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে এসেছেন অসংখ্য তিব্বতি ভিক্ষু।

তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের গেলুগপা শাখার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নাম‌ই দালাই লামা। আর এই শাখার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন একজন বাঙালি, বাংলাদেশের বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতিরা ডাকেন ‘জোবো চেনপো’ নামে। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘মহান দেবতা’। বুদ্ধের পরেই অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের স্থান লামা বৌদ্ধ ধর্মে। চতুর্দশ দালাই লামার পরেই আবির্ভূত হবেন পঞ্চদশ দালাই লামা। আর এ নিয়েই ধর্মশালার নির্বাসিত তিব্বত সরকার ও ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে বেইজিং। যদিও চিনের চোখ রাঙানিকে পাত্তা দিতেই নারাজ দালাই লামা ও ভারত কেউই।

আসলে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, দালাই লামার মৃত্যু হয় না দেহাবসানে পুনর্জন্ম হয় তাঁর। লামা পরম্পরা অনুযায়ী তিরোধানের পর চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো অন্য একজনের দেহে আবির্ভূত হবেন। কোন শিশুর দেহে দালাই লামা আবির্ভূত হয়েছেন, তা অনুসন্ধানের একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। রহস্যে ভরা অত্যন্ত গুপ্ত সেই প্রক্রিয়া। এতে যুক্ত থাকার অধিকারী কেবল দালাই লামার অত্যন্ত আস্থাভাজন হাতে গোনা কয়েকজন অতি উচ্চমার্গের লামা সাধকের। অনেকগুলো দৈব লক্ষ্মণ দেখে তাঁরাই শনাক্ত করবেন, কোন‌ শিশুর মধ্যে দালাই লামার আত্মার পুনর্জন্ম হয়েছে।

নব্বই বছর পড়লেন চতুর্দশ দালাই লামা। তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী দালাই লামার মৃত্যু হয় না দেহাবসানে পুনর্জন্ম হয় তাঁর। সংগৃহীত ছবি

নব্বই বছর বয়সেও যথেষ্ট সক্রিয় এবং সজ্ঞান চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি, মেধা, জ্ঞান ও পান্ডিত্য মানুষকে মুগ্ধ করে। শুধু ধর্মীয় শাস্ত্র ও আধ্যাত্ম বিদ্যাতেই নয়, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপরেও যথেষ্ট দখল আছে তাঁর। দালাই লামার ব্যক্তিত্ব ও বক্তব্য বিশ্বজুড়ে মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। শান্তিবাদী, অহিংস, নিরস্ত্র এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে তাই খুব ভয় পায় চিন।

তিব্বতের স্বাধীনতা হরণকারী চিন এখন চতুর্দশ দালাই লামার উত্তরসূরি খোঁজার কাজেও অযথা নাক গলাতে চাইছে। বেইজিংয়ের আব্দার, পঞ্চদশ দালাই লামা নির্বাচিত হবে তাদের দেশ থেকে তাদের ঠিক করা নিয়ম অনুযায়ী। এদিকে ভারতে আশ্রিত দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো অনেক আগেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে রেখেছেন, তাঁর উত্তরসূরী আসবেন মুক্ত পৃথিবী থেকে তিব্বতি লামা ধর্মের যাবতীয় পরম্পরা মেনেই।

ভিডিও: নিজের উত্তরসূরী বাছাই কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা নিয়ে জানাচ্ছেন চতুর্দশ দালাই লামা ভিডিও ক্রেডিট: টিবেট টিভি

সম্প্রতি নিজের ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রচারিত ভিডিও বার্তায় এ নিয়ে আর‌ও স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন চতুর্দশ দালাই লামা। দালাই লামা তিব্বতি সম্প্রদায়ের উদ্দেশে জানিয়েছেন, মৃত্যুর পর অবশ্যই তিনি আরেকজনের দেহে পুনর্জন্ম নেবেন এবং কার মধ্যে তাঁর জন্মান্তর হয়েছে, তা অনুসন্ধান ও পঞ্চদশ‌ দালাই লামা নিয়োগের একমাত্র কর্তৃত্ব অন্তর্যামী সন্ন্যাসীদের ট্রাস্টের। এই ব্যাপারে অন্য কার‌ও হস্তক্ষেপ গ্রাহ্য হবে না। চিনের উদ্দেশ্যে দালাই লামার বার্তা স্পষ্ট এবং বলাই বাহুল্য তাতে বেইজিংয়ের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। চিন পাল্টা দাবি করেছে, সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে পঞ্চদশ দালাই লামার নিয়োগ হবে সোনার পাত্র থেকে লটারির মাধ্যমে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দালাই লামা। উত্তরসূরী বিতর্কে দালাই লামার পাশে ভারত সরকার। সংগৃহীত ছবি

চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসোর ঘোষণাকে স্বীকৃতি জানাতে দেরি করে নি ভারত। ভারত সরকার‌ জানিয়ে দিয়েছে, দালাই লামার পুনর্জন্ম ও উত্তরসূরি অনুসন্ধান নিয়ে তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের পরম্পরা লঙ্ঘনের কোনও প্রশ্নই আসে না। শান্তি, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা নিয়ে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো। ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

বর্তমানে নির্বাসিত তিব্বত সরকার বা ‘সিটিএ’-র রাজধানী হিমাচলপ্রদেশের ধর্মশালাতেই বছরের অধিকাংশ সময় কাটান দালাই লামা। ভারতে এখন তিব্বতি শরণার্থীদের সংখ্যা ১ লক্ষের কাছাকাছি। চিন অধিকৃত তিব্বতে তিব্বতি সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৭০ থেকে ৭৫ লক্ষ। তিব্বতে হোক আর তিব্বতের বাইরে, চতুর্দশ দালাই লামাকেই তাদের অবিসংবাদী নেতা বলে মানেন তিব্বতিরা।

Feature Image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *