আদালতের নির্দেশে তিন পুলিশকর্মীর জেল: দলকানা আইসি-ওসিরা শিক্ষা নিন

আদালতের নির্দেশে তিন পুলিশকর্মীর জেল: দলকানা আইসি-ওসিরা শিক্ষা নিন


বিজেপি কর্মী অভিজিৎ সরকারকে খুনের মামলায় নারকেলডাঙ্গা থানার তৎকালীন ওসি শুভজিৎ সেন (পদোন্নতি পেয়ে পরে যিনি কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হয়েছিলেন এবং বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), থানার তৎকালীন এস‌আই রত্না সরকার এবং হোমগার্ড দীপঙ্কর দেবনাথ সহ চারজনের জামিন খারিজ করে দিয়ে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ব্যাঙ্কশাল আদালতের বিচারক। একুশের ভোট পরবর্তী হিংসার বলিদের একজন কাঁকুরগাছির অভিজিৎ। 

শুক্রবার মামলাটির শুনানি চলাকালে বিচারক যে মন্তব্য করেছেন তা সমাজের সকলের জন্য প্রণিধানযোগ্য। বিচারক বলেছেন, “রক্ষক‌ই ভক্ষক হয়ে গেলে‌ সমাজের কী হবে?” এই রাজ্যে বিরোধী দলের কর্মীকে খুনের মামলায় একসঙ্গে তিনজন পুলিশকর্মীকে জেলে পাঠানোর ঘটনা আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানি পশ্চিমবঙ্গের একটা দুরপনেয় কলঙ্ক। সত্তরের দশক থেকে যার শুরু এবং অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের যে আজ‌ও তা থেকে আমরা বেরোতে পারি নি।

‘বদলা নয়, বদল চাই’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তৃণমূলের শাসনে বাংলায় রাজনৈতিক হিংসা বেড়েছে ছাড়া কমে নি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর বাংলা জুড়ে এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের রাজত্ব নামিয়ে এনেছিল শাসকদল। ভোটের ফল বেরোনোর পর প্রথম তিন-চারদিন রাজ্যে আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না। প্রতিটা জেলায় বিজেপি কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া থেকে খুন, বাদ যায় নি কিছুই। বিজেপির শতশত কর্মী ও সমর্থক প্রাণ বাঁচাতে পাশের রাজ্যগুলিতে পর্যন্ত আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর যখন তৃণমূলের লোকেরা বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চড়াও হচ্ছিল, তাদের খুন করছিল, তখন পুলিশ কী করছিল? উত্তর, পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পশ্চিমবঙ্গে এটাই বহুদিনের রেওয়াজ। শাসকদলের লোকেরা যখন বিরোধীদের উপর হামলা করবে, তখন হয় পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকবে নয়তো আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মিথ্যে মামলা দিয়ে বসবে। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, মমতার জামানায় থানাগুলি তৃণমূলের পার্টি অফিসে পরিণত হয়েছে আর আইসি-ওসিরা পরিণত হয়েছেন শাসকদলের নেতায়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনের দল নিরপেক্ষ থাকার কথা। ভারতের সংবিধানেও তেমন‌ই নির্দেশ দেওয়া আছে। আইনের শাসন বজায় রাখতে পুলিশ ও জনপ্রশাসন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সাংবিধানিকভাবেই দায়বদ্ধ। ভোট পরবর্তী হিংসার একাধিক মামলায় রাজ্য পুলিশের তদন্তের উপর আস্থা রাখতে না পেরে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। এই রাজ্যে দলকানা হ‌ওয়ার জন্য পুলিশ এতটাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে যে বিচারপতিরা পর্যন্ত পুলিশের নিরপেক্ষতার উপর আস্থা হারিয়েছেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন, তাই রক্ষা! রাজনৈতিক হিংসার ঘটনায় শেষপর্যন্ত বহুক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পাচ্ছেন আক্রান্তরা।

কাঁকুরগাছিতে বিজেপি কর্মীকে খুনের মামলায় কলকাতা ব্যাঙ্কশাল আদালতের শুক্রবারের নির্দেশ পুলিশের জন্য একটা বিরাট শিক্ষা। রক্ষক‌ই ভক্ষক! তাই পুলিশের দুই আধিকারিক ও একজন হোমগার্ডকে জেলে ভরে দিয়েছেন বিচারক। বিচারকের বিচারকে ‘ল্যান্ডমার্ক’ বলা চলে। পুলিশ যদি মনে করে থাকে, রাজনৈতিক হানাহানির মামলায় শাসকদলের মন জুগিয়ে চললেই তারা পার পেয়ে যাবে, তবে পুলিশ ভুল করছে। ব্যাঙ্কশাল আদালতের নির্দেশ বলছে, পুলিশের মনোভাব বদলানোর সময় চলে এসেছে। শাসকদলের যে নেতাদের চাপে কাঁকুরগাছি থানার তৎকালীন ওসি, এস‌আই হত্যাকারীদের সহযোগিতা করেছিলেন, সেই নেতারা আজ কোথায়? তৃণমূলের কোনও নেতা তো তাঁদের জেলযাত্রা ঠেকাতে পারল না।

কাঁকুরগাছির অভিজিৎ খুনের মামলায় বেলেঘাটার তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পাল, কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি) স্বপন সমাদ্দার এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পাপিয়া ঘোষের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। জেল থেকে বাঁচতে এঁরাই এখন আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। মোদ্দা কথা, আদালতে পুলিশকর্মীরা বিপদে পড়লে কেউ তাঁদের রক্ষা করতে আসবে না। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব‌ও না!

সংবিধান পুলিশকে যে কর্তব্য পালনের নির্দেশ ও অধিকার দিয়েছে, পুলিশের আধিকারিদের উচিত শত চাপেও তাতে অবিচল থাকা। বিশেষ করে থানা যাঁরা সামলান, সেই আইসি-ওসিদের ব্যাঙ্কশাল আদালতের রায়ের পর মনে রাখতে হবে, তাঁদের কর্মফলের বোঝা তাঁদের ঊর্ধ্বতন সাহেবরা ব‌ইবেন না। যার কর্মফল তাকেই যে তা ভোগ করতে হয়, শুভজিৎ সেন, রত্না সরকার ও দীপঙ্কর দেবনাথরা তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।

 

Feature graphic is representational.

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *