বাংলাদেশ: রংপুরে আক্রান্ত রাজবংশী সম্প্রদায়ের হিন্দুরা, পুলিশের সামনেই গ্রামে হামলা, লুটপাট!

বাংলাদেশ: রংপুরে আক্রান্ত রাজবংশী সম্প্রদায়ের হিন্দুরা, পুলিশের সামনেই গ্রামে হামলা, লুটপাট!


ভাঙচুর ও লুটপাটে বাধা দেওয়ায় ঘরের হিন্দু নারীদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে নি হামলাকারীরা। আক্রান্ত এক মহিলার সুশ্রুষা করছেন বাড়ির লোকেরা। সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সবথেকে বড় অজুহাত ধর্মানুভূতিতে আঘাত। সামাজিক মাধ্যমে মহানবী কিম্বা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে পোস্ট দেওয়া হয়েছে, এই গুজব ছড়িয়ে গত পাঁচ বছরে বহুবার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। শেখ হাসিনার আমলেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই ট্রেন্ডের শুরু। গত ৫ অগাস্টের পর এমন কোনও সপ্তাহ নেই, বাংলাদেশের কোনও না কোনও জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আক্রান্ত হচ্ছে না।

হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অধিকাংশ অভিযোগ পরবর্তীকালে তদন্তে ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি হিন্দু যুবকদের নামে ফেক প্রোফাইল খুলে ইসলাম ধর্ম ও নবী অবমাননার পোস্ট দিয়ে হিন্দু গ্রামে হামলা চালানোর একাধিক ঘটনাও ঘটেছে বাংলাদেশে। রংপুরের ঘটনার পেছনেও তেমন কোনও ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ওই কিশোরকে শনিবার রাত আটটার দিকে আটক করে থানায় আনা হয়। রবিবার তাকে সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা দিয়ে আদালতে তোলে পুলিশ। নাবালক হ‌ওয়ায় অভিযুক্তকে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠায় আদালত।

কিশোরকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, এই দাবিতে শনিবার রাতে গঙ্গাচড়া থানা ঘেরাও করে একদল জনতা। উত্তেজিত জনতার লক্ষ্য ছিল, সনাতন ধর্মাবলম্বী কিশোরকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলা। পরে রাত ১০ টা নাগাদ জনতা থানা থেকে সরে গিয়ে অভিযুক্ত কিশোরের বাড়িতে হামলা করে। শুধু অভিযুক্তের বাড়িতেই নয়, আশেপাশে হিন্দুদের যত বাড়িঘর ছিল, ঢুকে ঢুকে ভাঙচুর চালায় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা। সংখ্যায় তারা ছিল শতশত। প্রত্যেকের হাতেই ছিল বাঁশ, লাঠি, বল্লম, দাউ, চাপাতি ও লোহার রড। ঘর থেকে পুরুষদের বের করে এনে মারধর এমনকি মেয়েদের রেহাই দেয় নি উন্মত্ত জনতা। পাড়াটিতে ছিল একটি কালীমন্দির। বিধর্মীদের হাতে মন্দিরটির পবিত্রতাও নষ্ট হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশের রংপুর জেলার গঙ্গাচড়ার বেদগাড়িতে আক্রান্ত হিন্দুরা। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় শতশত মুসলমান জনতা। সংগৃহীত ছবি

হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রাম আক্রান্ত হতে পারে, এই খবর থাকার পরেও পুলিশ আগাম সতর্কতা নেয় নি, এমন‌‌ই অভিযোগ উঠেছে সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতৃত্বের তরফে। এমনকি যখন উন্মত্ত জনতা হিন্দুদের ঘরে ঢুকে ঢুকে ভাঙচুর, লুটপাট চালাচ্ছে, তখন‌ও সেখানে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর দেখা মিলে নি। খবর পাওয়ার অনেক পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ ও সেনাসদস্যরা। পুলিশ ও সেনা পৌঁছানোর আগেই হামলাকারীরা সরে পড়েছে। পুলিশ পরিকল্পনা করেই মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের তাদের গ্রামে হামলা করার সুযোগ করে দিয়েছে বলে আক্রান্তদের অভিযোগ।

রবিবার দুপুরে জোহরের নামাজ শেষে আবার হাজার হাজার মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রামটিতে হামলা শুরু করে। এবার পুলিশের উপস্থিতিতেই ‘আল্লাহ আকবর’, ‘নাড়ায়ে তকবির’ ও ‘মালাউনেরা বাংলাদেশ ছাড়’ ধ্বনি দিয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে ঢুকে ভাঙচুর-লুটপাট চালায় জনতা। সোমবার সকালে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত গ্রামটিতে পৌঁছে দেখেন, গ্রামবাসীরা আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছেন। তাদের বাড়িঘর লন্ডভন্ড। অনেক ঘর থেকেই টাকাপয়সা, ছাগল-হাঁস-মুরগী, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য জিনিসপত্র লুঠ হয়েছে।

ভিডিও: রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার বেদগাড়িতে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলার পরের দৃশ্য। সংগৃহীত ফুটেজ

আক্রান্তরা রাজবংশী সম্প্রদায়ের হিন্দু। আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি চলে যাচ্ছেন অনেকেই। হামলার ঘটনায় এখনও পর্যন্ত একজনকেও গ্রেফতার করে নি পুলিশ। রবীন্দ্রনাথ রায় নামে এক গৃহস্থ মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির উঠোনে বসেছিলেন। রবীন্দ্রবাবুর বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাঁর স্ত্রীর এক ভরি স্বর্ণ, শাড়ি-জামা-কাপড় এমনকি জমির দলিল পর্যন্ত লুঠ করেছে হামলাকারীরা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “বাংলাদেশত হামরা হিন্দু মানষি আর বাঁচি পারিম না। কোন দোষত যে বাংলাদেশত থাকি গেইলু। ঘরের মাইয়া-বউর ইজ্জত লুট করিবে বলে হুমকি দিছে ওরা।”


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *