আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দ্বিতীয় দফায় হোয়াইট হাউসে ঢোকার পর থেকেই ভারতকে বেইজ্জত করার কোনও সুযোগই হাত ছাড়া করছেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারতবন্ধু তথা মোদীবন্ধু তকমা পাওয়া ট্রাম্পকে নিয়ে বেজায় বিপদে সাউথ ব্লক ও দেশের দক্ষিণপন্থী শিবির। ভারত অসন্তুষ্ট ও অপমানিত হয়, দেখা যাচ্ছে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে মোদীবন্ধু ট্রাম্পের ইদানিং উৎসাহের শেষ নেই। পাকিস্তানের ভারতবিদ্বেষী সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে ডেকে ট্রাম্পের জামাই আদরের ধাক্কা মোদী সরকার কাটিয়ে ওঠার আগেই ভারত ভ্রমণ নিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল ট্রাম্প প্রশাসন।
যে ভাষায় ভারত ভ্রমণ নিয়ে মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক করে লম্বা ‘ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসরি’ জারি করেছে ভারতের আমেরিকান দূতাবাস ও কনস্যুলেট, তা ভারত সরকারের জন্য রীতিমতো অপমানজনক ও অস্বস্তির। দিল্লির আমেরিকান দূতাবাস থেকে জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, “ভারতে ধর্ষণ, হিংসা ও সন্ত্রাসের ঘটনা দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার নাগরিকদের জন্য ভারত ভ্রমণ থেকে বিরত থাকাই ভাল।” ভারতে সবথেকে বৃদ্ধি পাওয়া অপরাধগুলির তালিকায় ধর্ষণ অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। মহিলাদের একা একা ভারত ভ্রমণে আসা একেবারেই উচিত নয় বলে মনে করছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

ভারত ভ্রমণে ইচ্ছুক দেশের নাগরিকদের সতর্ক করে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, “ভারতে যে হারে সন্ত্রাস ও অপরাধ বেড়ে চলেছে, তাতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারতের কিছু কিছু এলাকায় হিংসাত্মক অপরাধ ও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বেশি। ধর্ষণের মতো অপরাধ সবচেয়ে বেশি ভারতে। হিংসাত্মক অপরাধের তালিকায় যৌন নির্যাতনের ঘটনা উপরের দিকে। যেসব জায়গায় পর্যটকদের যাতায়াত আছে, সেইসব জায়গাতেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।”
নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, যে কোনও মুহূর্তে ভারতে সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালাতে পারে। শপিং মল, বাজার, পর্যটনস্থল, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল সহ পরিবহণ কেন্দ্রগুলি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা হওয়ার আশঙ্কা আছে। ভারতের গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সেখানে আমেরিকার নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা পাওয়া কার্যত অসম্ভব। ভারতে ভ্রমণ করার সময় মার্কিন নাগরিকদের স্যাটেলাইট টেলিফোন বা জিপিএস ডিভাইস বহন না করতে বলা হয়েছে। এতে জেল ও জরিমানার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর।
ভারতের কোন কোন অঞ্চল থেকে আমেরিকানদের দূরে থাকতে হবে, নির্দেশিকায় তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে। জম্মু-কাশ্মীর, ভারত-পাক সীমান্তবর্তী যে কোনও অঞ্চল, মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলি পরিহার করতে দেশের নাগরিকদের পরামর্শ দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের পররাষ্ট্র দফতর। মণিপুর, মেঘালয় এমনকি উত্তরপ্রদেশেও ভ্রমণে যেতে আমেরিকার নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতে বসবাসকারী আমেরিকার সরকারি কর্মচারীদের আগাম অনুমতি ছাড়া এইসব প্রদেশের রাজধানী ত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

যে ভাষায় নিজের নাগরিকদের ভারত নিয়ে সতর্ক করে জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে আমেরিকা সরকার, তা দেখে মনে হচ্ছে ভারত আমেরিকার শত্রুরাষ্ট্র এবং ভারতের মাটি আমেরিকার নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। অথচ বাস্তবতা হল, এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্র রাজ্য মণিপুর ছাড়া ভারতের বাদবাকি অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্টই নিয়ন্ত্রণে। পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড ও ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের রেশ কাটিয়ে কাশ্মীরের পরিস্থিতিও স্বাভাবিকের দিকে। ছত্তীসগঢ়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অপারেশন কাগারের ঠেলায় মাওবাদীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তেলাঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এমনকি বিহার, ঝাড়খণ্ডেও মাওবাদী হিংসা অতীতের স্মৃতি মাত্র। ওড়িশার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমেরিকার যে কোনও প্রদেশের তুলনায় ভাল।
রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন, কোন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভারতকে আমেরিকার নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করল ট্রাম্প প্রশাসন? পরিসংখ্যান নিয়ে টানাটানি শুরু করলে কিন্তু দেখা যাবে, আমেরিকাতেই মানুষের নিরাপত্তা ভারতের থেকে কম। কোন অন্ধ রাগে ট্রাম্প ভারতের পর্যটন শিল্পকে ধ্বংস করতে চান? আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের সম্মানহানি করতে ইচ্ছে করেই কি এমন নির্দেশিকা পররাষ্ট্র দফতরকে দিয়ে জারি করিয়েছেন ‘ভারতবন্ধু’ ডোনাল্ড ট্রাম্প?

বলা হয়ে থাকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চলে ভারত আমেরিকার সবথেকে বড় কৌশলগত মিত্র। বন্ধু খুশি হয়, দ্বিতীয় দফায় আমেরিকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন কোনও পদক্ষেপ কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করেছেন? শুল্ক নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবেন, এমন পূর্বাভাস ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু বন্ধু ট্রাম্প যে ভারতের পেছনে কাঠিবাজিকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলবেন, স্বপ্নেও কি তা ভেবেছিলেন মোদী? নভেম্বরে এই ট্রাম্পের বিজয়েই ভারতের মিডিয়ার একটি বড় অংশ উল্লাসে মেতে উঠেছিল, যে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বলছেন, মোদী তাঁর ভাল বন্ধু বটে কিন্তু পাকিস্তানকেও তিনি খুব ভালবাসেন। ট্রাম্পের পাকিস্তান প্রীতির ঠেলায় সাউথ ব্লক যে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বন্ধু থাকলে শত্রুর দরকার পড়ে না।
Feature graphic is representational and created by NNDC.