মহাকুম্ভে মানুষের মহামিলন মেলায় কত অভিজ্ঞতা! ব্যবস্থাপনার ভাল ও মন্দ দিক

মহাকুম্ভে মানুষের মহামিলন মেলায় কত অভিজ্ঞতা! ব্যবস্থাপনার ভাল ও মন্দ দিক


প্রয়াগরাজের ত্রিবেণীসঙ্গমে মহাকুম্ভ সদ্য‌ই শেষ হল। ৪৪ দিনের মহামিলন মেলা! বিবিধতা, বর্ণাঢ্যতা ও বিশালতায় এমন আধ্যাত্মিক জনসমাগম দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। মহাকুম্ভ নিয়ে বাজারে অনেক উচ্ছ্বাস ও সমালোচনা। অমৃতকুম্ভে ডুব দিয়ে তাঁর নিজের কী অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে, তা ধারাবাহিকভাবে জানাচ্ছেন নব্যেন্দু মৌলিক, তৃতীয় পর্বে পড়ুন-

আমার বহু পরিচিত মানুষ বলেন আমার নাকি বন্ধু যোগ খুব ভাল। খুব সহজেই আমার নাকি বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কেউ কেউ তো এমনও বলেন আমি নাকি প্রচুর “মানুষ কামাই (রোজগার)” করেছি। সেই রোজগার নাকি বহু বহু আর্থিক রোজগারের থেকেও উত্তম। আমি অবশ্য এত তাত্ত্বিক কথার বিশেষ ধার ধারি না। এই টুকু বুঝি মানুষের সাথে মিশে আমি আনন্দ পাই। তাই নতুন মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেলে, তার সাথে বন্ধুত্ব বা ভালো সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা আমি করি। এতে আমি মানসিক তৃপ্তি লাভ করি। পরমেশ্বর ঈশ্বর সবসময়ই এই কাজে আমাকে সাহায্য করেন বলেই সবক্ষেত্রে আমি সফল হই। প্রয়াগরাজেও যার ব্যতিক্রম হয়নি।

রাহুল বিশ্বকর্মা তেমনই আমার এক বন্ধু। প্রয়াগরাজ রওনা হওয়ার আগে তো দূর, প্রয়াগরাজে প্রবেশের আগের মুহূর্ত অবধি যার কোনো অস্তিত্বই আমার কাছে ছিল না। বয়স ৩০ ছুঁইছুঁই হবে। শ্যামলা বর্ণ, উচ্চতা মাঝারি, দেহের গঠন স্বাভাবিক। চোখ দুটি যথেষ্ট আকর্ষণীয়। বাচনভঙ্গি, মুখের হাসি ততটাই সুন্দর যে কথা বলে তৃপ্তি লাগে। ১১ই ফেব্রুয়ারী সকালে যখন প্রয়াগরাজ প্রবেশের পর কানহা পার্কিং-এর ভেতরের শৌচালয়ে শৌচকর্ম করতে গেলাম, ঠিক তখনই চা খেতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হলো ধাবা মালিক রাহুল বিশ্বাকর্মার সাথে। এরপর থেকে কিভাবে রাহুলভাইয়ার আতিথ্যে আমাদের প্রয়াগ তীর্থ যাত্রা এগিয়ে চললো তা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এখানে বলতে হবে কিছু বিশেষ কথা। যা আর পাঁচজন ধাবা মালিক ও তার ধাবায় আশ্রয় নেওয়া অতিথির সম্পর্কের বাইরেও এই সম্পর্ককে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের রূপদান করতে সক্ষম হয়েছে।

রাহুল বিশ্বকর্মা। প্রয়াগের যুবক। ধাবা মালিক। যাঁর ধাবায় উঠেছিলাম। শেষ পর্যন্ত মহাকুম্ভে রাহুল হয়ে উঠল আমাদের পরম বন্ধু। ছবি: লেখক

সকাল সকাল চা-পান দিয়েই শুরু হয়েছিল পরিচয়। দ্রুত আমি তাকে জানালাম আমাদের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা তাকেই করতে হবে। যদিও তার শিবিরে সর্বপ্রথম যান আমার সফরসঙ্গী সন্টু দা। কিন্তু কিছুক্ষণবাদেই আমাদের সাথে তার সুসম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা তার উপর আস্থা রাখি। মেলায় যাওয়া ফিরে আসা প্রতিটি দায়িত্ব তার উপরেই ছাড়া হয়। এরমধ্যে কিভাবে যে রাহুল ভাইয়া আমার এতটা কেয়ারিং ফ্রেইন্ড হয়ে উঠল, আমি বুঝতেই পারলাম না। সঠিক সময়ে চায়ের ব্যবস্থা, নিজের থেকে কোনও সমস্যা আছে কিনা জানতে চাওয়া, অতিরিক্ত কম্বলের ব্যবস্থা, ঘুমানোর বিছানার ব্যবস্থা সবই করতে থাকলেন তিনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় বাসি বিছানায় সকালের চা, যা আমার সব সময়েরই অভ্যাস, তাও রক্ষা করেছেন রাহুল ভাইয়া।

দ্বিতীয় দিন গঙ্গাস্নান সেরে যখন ধাবায় ফিরে ফের পরিস্কার জলে স্নান করবো, তখন স্নানের জলের বিশেষ ব্যবস্থা এমনকি পাত্রভর্তি জলের ব্যবস্থা আমার জন্য আলাদা করে করেছেন রাহুল ভাই। চূড়ান্ত ব্যস্ততার মাঝেও তার বাড়ি ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছেন আমাকে। হাইরোডে জমি গিয়েছে তাদের। তার বিনিময়ে মিলেছে অর্থ, সেই অর্থে বাড়ি তৈরি হচ্ছে রাহুলদের। পারিবারিক এমন অনেক কথাও সামান্য বিশ্বাসেই আমাকে বলতে দ্বিধা করেন নি এই যুবক। এমনকি মিলনরানী সরকারকে তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দিতেও (যে গল্প আমি পরবর্তীতে বলবো) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন রাহুল বিশ্বকর্মা। প্রয়াগরাজ ছাড়ার আগে যখন রাহুল ভাইয়ার ধাবার খরচ মেটানোর সময় এসেছে তখন একাধিক দিনের খাবারের টাকা, সম্পূর্ণ সময়ের থাকার টাকা সহ একাধিক তার প্রাপ্য টাকা আমাদের থেকে নেন নি রাহুল ভাইয়া। বলা ভাল, জোর করেও দিতে পারিনি। কোন‌ও ভালোবাসায় বা বন্ধুত্বে সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাদের সাথে রাহুল ভাই এভাবে মিশে গিয়ে আমাদের আপন করে নিতে পেরেছেন আমি জানিনা। তার জায়গায় আমরা থাকলে আদৌও করতে পারতাম কিনা জানি না!

এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা হয়তো এখানে নেই। ব্যাক্তিগত বন্ধুত্বের কথা প্রকাশ্যে চাউর করার‌ও হয়তো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই গল্প সকলের জানা দরকার। অবশ্যই জানা দরকার। কারণ, চারিদিকে যখন প্রয়াগরাজ গিয়ে মানুষের চূড়ান্ত সমস্যায় পড়ার কথা শোনা যাচ্ছে, যখন কানে আসছে লোক ঠকিয়ে জিনিসের বা খাদ্য সামগ্রীর দাম ডবলের বেশি নেওয়ার। তখন রাহুল বিশ্বকর্মা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক। রাহুল বিশ্বকর্মা প্রতীক হয়ে উঠুক সততা, ভালো মানসিকতা এবং বন্ধুত্বের। ভাল মানুষ সর্বত্র থাকেন। ঠিক যেমন খারাপও থাকে। প্রয়োজন শুধু ভালোকে খুঁজে নেওয়ার। তা না করে একটি এলাকায় সব মানুষের গায়ে কাদা ছিটিয়ে দেওয়া সঠিক নয়। এই প্রয়াগতীর্থে হয়তো এমন অনেক রাহুল আছেন। যারা ভাল মানুষ বলেই কোটি কোটি মানুষের সমাগম হওয়া সত্ত্বেও মোটের উপর নির্বিঘ্নেই কুম্ভমেলা ৪৪ দিন ধরে চলেছিল। সকলেই রাহুল ভাইয়ার মতো হবেন তা নিশ্চয়ই নয়। কিছু মানুষ খারাপও হবেন। এই ধরনের লোক ঠকানো মানুষ সর্বত্রই আছেন। আমাদের উচিত রাহুলের মতো সঠিক বন্ধুকে খুঁজে নেওয়া।

বামে প্রয়াগরাজের যুবক রাহুল বিশ্বকর্মা। মাঝে সফরসঙ্গী সপ্তর্ষি। মহাকুম্ভে গিয়ে রাহুলের মতো বন্ধু জুটে যাবে ভাবি নি। ছবি: লেখক

রাহুল বিশ্বকর্মা এমনই এক বন্ধু, যাকে ছেড়ে বিদায় নিতে আমার মন কেঁদেছিল। বিশ্বায়নের যুগে সম্পর্কের মাধ্যম ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাহুল বিশ্বকর্মার সাথে সেই যোগাযোগ চিরকাল বজায় থাকবে। রাহুলের বন্ধুত্ব এবং তীর্থরাজ প্রয়াগের আধ্যাত্মিকতার স্পর্শই আমাকে আবারও প্রয়াগরাজমুখী করতে বাধ্য করবে।

মহাকুম্ভ ২০২৫-এর প্রয়াগরাজে তিনদিন ছিলাম। এই তিনদিনের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হল এটি। যা একেবারেই আশ্চর্যজনক এবং হঠাৎ। যেই অভিজ্ঞতা জন্মজন্মান্তরেও ভোলার নয়। বহুকাল ধরেই শুনে আসছি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যা ঘটে তা আগে থেকে নির্দৃষ্ট। পৃথিবী আসলে একটি নাট্যমঞ্চ। এখানে আমরা প্রত্যেকে সেই নাটকের অভিনেতা। এই নাটকের নির্দেশক স্বয়ং ঈশ্বর। কোথায় কি হবে তা পূর্ব নির্ধারিত। “ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে” এই প্রবাদ শুনেছি বহুকাল। তার বাস্তব রূপ ঈশ্বর দেখিয়ে দিল আমার সাথেই। সমাজকর্মী হিসেবে সামাজিক কাজকর্ম আমার প্রতিদিনের অঙ্গ। মানুষের সাথে সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে এতদূরে এবং মহাকুম্ভের মতো মিলনতীর্থে ভগবান আমাকে দিয়ে সেই সামাজিক কাজ করিয়েই নেবে তা আমি কল্পনাতেও আনতে পারিনি। হয়তো বা এই উদ্দেশ্যেই আমার কুম্ভে যাওয়া। এটাই হয়তো আমার কুম্ভতীর্থের আসল ‘অমৃত প্রাপ্তি’। সবই মনের ভাবনা মাত্র।

১২ই ফেব্রুয়ারী আনুমানিক প্রায় বিকাল চারটে। শাহিস্নান সেরে ফিরেছি অনেকক্ষণ হল। সেদিন রাহুলভাইয়ার বাইক সার্ভিস হাতে গোনা। তাই আলাদা আলাদা করে আমাদের দলের সকলকে স্নানে যেতে হচ্ছিল। আগেই বলেছি, সবার প্রথমে সেদিন আমি এবং আমার সাথী সপ্তর্ষি রাহুল ভাইয়ের সাথে স্নানে গিয়েছিলাম। আমরা ফিরে আসার পর একে একে বাকিরাও যাচ্ছিল। তাই আমি এবং সপ্তর্ষি সহ বাকি যাদের স্নান হয়ে গিয়েছে তারা একসাথে রাহুল ভাই-এর সঙ্গম ধাবায় একটি খাটিয়ার উপর বসে বাকিদের ফিরে আসার প্রতিক্ষা করছি। ক্ষিদে ততক্ষণে পেটে ডন মারছে। সারাদিন খাওয়া হয়নি। সকলে স্নান সেরে ফিরলেই আমাদের খেতে বসার কথা। এমন সময় আমার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। সদ্য কথা বলা শুরু করেছি আমার মামির সাথে। ইতিমধ্যেই এক মাঝবয়েসী বাঙালি মহিলার কন্ঠস্বর। “আচ্ছা দাদা এখানে মুর্শিদাবাদের বাস কোথায় আছে?” আওয়াজ শুনেই তাকিয়ে দেখি এক সধবা বাঙালি ভদ্রমহিলা। পরনে তুঁতে রঙের শাড়ি। গলায় তুলসীর মালা, পায়ে জুতো নেই, গোটা বস্ত্রে বালি মাখা। সাথে আর কোনো কিছু নেই। ঘুরিয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করি! “আপনি বাস খুঁজছেন কেন? আপনি কি হারিয়ে গিয়েছেন!” উত্তরে অঝোরে কান্নার সাথে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন “হ্যাঁ”।

মধ্য বয়সী মহিলার নাম মিলনরানী সরকার। বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জের সাধকবাগ বড় আখড়ায়। স্বামী গৌরচন্দ্র সরকারের সাথে এসেছিলেন কুম্ভমেলায়। বাড়ি থেকে ছেলে মেয়েরা আপত্তি করেছিলেন। পাছে মা হারিয়ে যান। কিন্তু শোনেননি বৃদ্ধ দম্পতি। সারাদিন ঈশ্বর সাধনা নিয়ে থাকেন। খান নিরামিষ। তাই মনের জোর নিয়েই এসেছিলেন কুম্ভে। জিয়াগঞ্জ থেকে একটি বাসে করে একদল পুণ্যার্থী এসেছিলেন কুম্ভে। তাদের সাথেই আসা সরকার দম্পতির। ১২ তারিখ ভোর তিনটেয় নেমেছিলেন প্রয়াগরাজে। তারপর স্বামীর হাত ধরে সঙ্গম ঘাটে। সবই ঠিকঠাক চলছিল। সঙ্গম ঘাটের প্রবল ভিড়ে স্বামীর সাথেই নেমেছিলেন ত্রিবেণী সঙ্গমে শাহিস্নান করতে। কিন্তু ডুব দিতেই হল বিপত্তি। ছেলে মেয়েরা যে ভয়টি পেয়েছিলেন সেটাই ফলে গেল। হারিয়েই গেলেন মিলনরানী। ডুব দিয়ে উঠে দেখেন আশপাশে কোথাও স্বামী নেই। নেই সফরসঙ্গী বাকিদের কেউই।

ভিনরাজ্যে পুণ্যলাভে এসে অথৈজলে মহিলা। ভোর গড়িয়ে সকাল, সকাল গড়িয়ে বেলা, বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার খালি পায়ে ভেজা গায়ে হাঁটতে থাকলেন মিলনরানী দেবী। হাতে ত্রিবেণী সঙ্গমের জল ভর্তি একটি পাত্র। বহুক্ষণ এভাবে খুঁজতে খুঁজতে অসহায় মিলনরানী কখনও গেলেন পুলিশের কাছে, কখনও গেলেন সাধারণ পুণ্যার্থীদের কাছে সাহায্য চাইতে। অনেকেই খাবার দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেও, মিলনরানীর আসল যন্ত্রণা উপশমে এগিয়ে এলেন না কেউই। মিলনরানী যে তখন ক্ষুধা, তৃষ্ণা সবকিছুর যন্ত্রণা ভুলেই গিয়েছেন। খালি পায়ে পথ হাঁটতেও তার অসুবিধার কথা মাথাতেই আসছে না। সে চাইছে তার স্বামীর খোঁজ। স্বজনের খোঁজ। চোখে মুখে তার আতঙ্ক স্পষ্ট। তাকেও যে ঘরে ফিরতে হবে! তার সাজানো সংসার, ছেলে, মেয়ে, স্বামী, নাতি-নাতনী স্বজন আরও কত কে! তাদের সাথে কি আর দেখা হবে না! কীভাবে খুঁজে পাবেন তাদের! নাকি এভাবেই ঘুরে বেড়াতে হবে! এইরকম নানান চিন্তায় যখন মিলনরানী মগ্ন, তখন মিলনরানীর সহায়তায় এগিয়ে আসেনি উত্তরপ্রদেশ পুলিশ বা প্রশাসন।

বাঙালি মহিলার ভাষাই বুঝতে পারেননি কেউ। সেই দোহাই দিয়ে যাবতীয় দায় ঝেড়ে ফেলেছে খাকি উর্দিধারীরা। কোথায় “মে আই হেম্প ইউ কর্ণার”! কোথায় ” লস্ট এণ্ড ফাউন্ড সেন্টার”! মিলনরানীর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি কেউই। সাধারণ পুণ্যার্থীরা সেখানে আর কিই বা করতে পারেন! অগত্যা এক পুণ্যার্থী তার হাতে ২০০ টাকা দিয়ে একটি টোটোয় তুলে দেন। টোটো চালককে বলেন “কানহা পার্কিং” এর সামনে নামিয়ে দিতে। কারণ তিনি নাকি এই পার্কিং-এ বাংলার কিছু গাড়ি দেখেছেন। যদি সেখানে কোন‌‌ও সুরাহা হয়, এই ভাবনাতেই টোটোয় চেপে ৯ কিমি এসে কানহা পার্কিং-এ নামেন মিলনরানী। এই হুড়োহুড়ির মধ্যে হাতের গঙ্গাজলের পাত্রটিও হারিয়ে গেছে মিলনরানীর। যদিও তখন জলের কথা মাথাতেও নেই তার। চিন্তা একটাই, কীভাবে বাড়ির লোকের সাথে সাক্ষাৎ হবে।

এভাবে চলতে চলতে এই অধমের সামনে উপস্থিত হন মিলনরানী দেবী। তারপরেই জানান তিনি হারিয়ে গিয়েছেন। এই শুনেই আট বছর ধরে নানান কঠিন কঠিন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী এই অধমের বুঝতে অসুবিধা হয়নি একটি বড় লড়াই শুরু হল তার। মিলনরানীর “ঘর-বাপসির” যুদ্ধ শুরু হল। প্রথমেই সঙ্গম ধাবায় খাটিয়ায় বসালাম ভদ্রমহিলাকে। আশ্বস্ত করলাম চিন্তার কোন‌ও কারণ নেই। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আগে আপনি জল খান। সামান্য জলে গলা ভিজিয়েই কাঁদতে কাঁদতে উপরে বর্ণিত কাহিনী জানালেন মিলনরানী দেবী। জানালেন তার কাছে ফোন নম্বর বা ফোন কোনো কিছুই নেই। শুধু স্বামীর নাম, ছেলের নাম এবং ঠিকানা দিলেন। জানালেন জিয়াগঞ্জ থানা এলাকায় বাড়ি তার।

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুরু করলাম লড়াই। “গুগুল বাবা”-র সাহায্য নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের পোর্টালে গিয়ে চলে গেলাম ” ইমপর্টেন্ট কনটাক্টস্”-এ। সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করলাম ওসি জিয়াগঞ্জ-এর সিইউজি নম্বর। প্রথমে যে নম্বরে ফোন করলাম সেটি আবার ওসি জিয়াগঞ্জ-এর নম্বর নয়। একটি অন্য থানার আইসি সাহেবের নম্বর। তাকেই বললাম ওসি জিয়াগঞ্জ-এর সিইউজি নম্বর দিতে। সাথে সাথেই দিলেন তিনি। নম্বর মিলতেই লাগালাম ফোন। ওসি জিয়াগঞ্জ বিশ্বরূপ ঘোষালকে সম্পূর্ণ ঘটনা জানালাম। তিনি বললেন মহিলার ছবি এবং যাবতীয় বিবরণ হোয়াটসঅ্যাপ করতে। সাথে সাথেই করা হল। নিজের “কনট্যাক্টস্”-এ থাকা পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের সমস্ত আইএএস এবং আইপিএস-দের বিষয়টি জানালাম হোয়াটসঅ্যাপে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপারের সিইউজি জোগাড় করে, ফোন করলাম তাকেও। গোটা ঘটনা জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে তাকেও যাবতীয় তথ্য পাঠানো হল। এরই মধ্যে ফোন করলেন পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অভিষেক কুমার তিওয়ারি, আইএএস। যাকে কিছুক্ষণ আগেই হোয়াটসঅ্যাপে যাবতীয় তথ্য দিয়েছিলাম আমি।

তিনি জানালেন গোটা ঘটনা মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককে তিনি জানিয়েছেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন ভদ্রমহিলাকে ছেড়ে না দেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাকে ফোন করা হবে। প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্থ সাহায্য পাঠাবে। আমি যেন তাকে ট্রেনে বা বাসে মুর্শিদাবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আমি অভিষেক স্যারকে আশ্বস্ত করি, ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। প্রয়োজনে আমি নিজে আমাদের গাড়িতে করে ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। এর জন্য কোন‌ও আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই। ট্রেনে বা বাসে ওনাকে পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ তাহলে উনি আবার হারিয়ে যাবেন। এছাড়াও ট্রেন বা বাসে যে পরিমাণ ভীড়, তাতে ওনার বড় ক্ষতি হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই প্রশাসন যেন ওনার বাড়িতে গিয়ে বাড়ির লোকের নম্বর আমাকে পাঠায় সেটুকু নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানাই আমি। একই অনুরোধ আমি এসপি মুর্শিদাবাদ এবং ওসি জিয়াগঞ্জ-এর কাছেও করেছিলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিডিও জিয়াগঞ্জ আমাকে ফোন করলেন। বুঝলাম অভিষেক স্যারের কথাতেই ফোন এল। তাকেও সব জানালাম। ঘটনাগুলি এতটা বিস্তারিত হলেও, এই যাবতীয় বিষয়টি ঘটছিল মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই। এর সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে ভদ্রমহিলার ছেলে, স্বামী এবং যে বাসে তিনি এসেছিলেন তার চালকের নম্বর পাঠালেন জিয়াগঞ্জ থানার ওসি। একই তথ্য এল বিডিও-র মাধ্যমেও। সকলেই আমাকে একটাই অনুরোধ করছেন – দয়া করে ওনাকে ছাড়বেন না। প্রশাসনকে আমি প্রতিটি ধাপে আশ্বস্তই করে গেলাম। বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি একজন ২৪ ঘন্টার সমাজকর্মী। যে কাজ আমার উপর বর্তেছে, তা আমার প্রতিদিনের কাজেরই অঙ্গ। তাই চিন্তার কারণ নেই।

এর মধ্যে সমস্যা হল আরও একটি। ভদ্রমহিলার স্বামী, ছেলে এবং বাসের চালকের ফোনে চতুর্দিক থেকে এত ফোন হয়তো যেতে শুরু করলো, যে আমার ফোন তোলাটা বা আমাকে ফোন করে কথা বলাটা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা তারা ভুলেই গেলো। প্রত্যেককে ফোন করে বিজি পেতে পেতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় ভদ্রমহিলার ছেলে আমাকে ফোন ব্যাক করলেন৷ ভদ্রলোক মহারাষ্ট্রে থাকেন কর্মসূত্রে। প্রথমেই তাকে বললাম আপনি আগে আপনার মায়ের সাথে একটু কথা বলুন। ওনাকে আশ্বস্ত করুন। সেইমতো ফোন দিলাম মিলনরানী দেবীকে। ছেলের গলার স্বরে আত্মায় জল এলো মিলনরানীর। চোখে অঝোরে জল। মা-ছেলের কথা শুনতে শুনতে একটা সময় চোখে জল চলে আসছিলো আমাদের সকলেরই। এরপর ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে, ওনার ছেলেকে বললাম আপনার বাবার সাথে কথা বলান। ওনারা কোথায় আছেন সেটা জানতে হবে। চিন্তা করবেন না, আপনার মা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছেন।

বাবার সাথে কথা বলে ছেলে জানালো মিলনরানীকে খুঁজে না পেয়ে বাসের বাকি যাত্রীদের সাথে বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন মিলনরানী দেবীর স্বামী। এই কথা শুনে চূড়ান্ত হতাশ হয়েছিলাম আমি৷ এও সম্ভব! নিজের স্ত্রীকে এই জনসমুদ্রে চূড়ান্ত বিপদে ছেড়ে কিভাবে বাসে চাপলেন গৌরবাবু! বাসের বাকি যাত্রীদের কাণ্ডজ্ঞান থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। তারা বহু অর্থ খরচ করে পুণ্য অর্জনে এসেছেন। মিলনরানীর জন্য তাদের ঘোরাঘুরি নষ্ট হবে কেন! তা কি করা যায় নাকি! তারা তো রওনা হবেনই। কিন্তু তাই বলে স্বামী! স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো জন্মজন্মান্তরের। তিনি কিভাবে বাড়ির পথে যাত্রা করলেন, তা ভেবে ততক্ষণে কুল-কিনারা পাচ্ছি না আমি এবং আমার সাথীরা।

এদিকে বাসতো চলে গিয়েছে। কিন্তু কতদূর গিয়েছে? তাও জানা যাচ্ছে না। বাসের চালককে জোরের সাথে বললাম কাউকে জিজ্ঞেস করুন কোথায় আছেন! তিনি এক হিন্দিভাষী ভদ্রলোককে ফোন দিলেন। তিনি বলছেন জৌনপুর। যার দূরত্ব প্রয়াগরাজ থেকে ১০৪ কিলোমিটার। আমি বা আমার সাথীরা এই দূরত্বও গাড়ি করে পৌঁছে দিতে রাজিই ছিলাম। কিন্তু এভাবে কি চূড়ান্ত জনবিস্ফোরণের মাঝে গাড়ি নিয়ে আন্দাজে পথ চলা যায়! নিশ্চয়ই নয়। নিশ্চিত হতে হবে তো। বাসের চালককে বললাম গুগুল লোকেশন পাঠান। এদিকে জিয়াগঞ্জ এর ওসি এবং বিডিওকে বললাম, আপনাদের এলাকার বাস আপনাদের কথা শুনবে। আপনি বাস চালককে বলুন বাস যেখানে আছে আছে সেখানেই থামিয়ে রাখতে। লোকেশন পেলেই আমরা রওনা হব। দ্রুত পৌঁছে দেব। বাসে যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগই মাঝবয়েসী। মোবাইল ব্যবহারের পারদর্শিতা কম। এমনটাই বলছিলেন বাসের চালক। বেশকিছুক্ষণ বাদে এলো কারেন্ট লোকেশন৷ সেই লোকেশন গুগুল ম্যাপে দিতেই মুখে হাসি ফুটলো। মাত্র ১৭ কিমি দূরেই দাঁড়িয়ে আছে বাস।

মহিলাকে জানালাম চিন্তার কোনো কারণ নেই। সামনেই বাস আছে। আপনাকে দ্রুত পৌঁছে দিয়ে আসবো। আপনি একটু খাওয়া দাওয়া করে নিন। মিলনরানী দেবী জানালেন তিনি সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। পেঁয়াজ রসুনের স্পর্শ খান না। আমরা তাকে আশ্বস্ত করলাম, রাহুল ভাই-এর ধাবায় পেঁয়াজ রসুন নেই। আমরা নিজেরাও এই সফরে এগুলি বর্জন করেছি। প্রথমে তবুও আপত্তি করলেও অবশেষে নিমরাজি হলেন। তবে খাওয়া বলতে মুখে ছোঁয়ানো। ওই সামান্য এক দুই গ্রাস খেয়েই ইতি টানলেন মিলনরানী দেবী। অবশেষে রওনা হওয়ার পালা।

মহাকুম্ভে হারিয়ে যাওয়া মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের মিলনরানী সরকার। প্রয়াগ থেকে ১৭ কিমি দূরে গিয়ে তাঁকে বাসে তুলে দিয়ে আসি আমরা। ছবি: লেখক

মিলনরানী দেবীকে কথা তো দিলাম। কিন্তু বাস্তবের ১৭ কিমি আর কুম্ভমেলার শাহী স্নানের দিন প্রয়াগরাজের ১৭ কিমি কি এক! যে প্রবল জ্যাম, তা উপেক্ষা করে যাবো কিভাবে। এক্ষেত্রেও ত্রাতা রাহুল ভাই। কারণ ভেতরের রাস্তার সন্ধান একমাত্র দিতে পারবে ওই। সেই মতো তাকেও সাথে নিলাম। গাড়িতে উঠে বসলাম আমি, মিলনরানী দেবী, রাহুল ভাই এবং সপ্তর্ষি। চালকের আসনে শুভঙ্কর। দীর্ঘ মাঠঘাট টপকে ১৭ কিমি গেলাম প্রায় ৩০ কিমি ঘুরে। অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম ওদের পাঠানো গন্তব্যে। এতক্ষণে মিলনরানী দেবীর মাথায় এসেছে তার হারিয়ে যাওয়া গঙ্গাজলের কথা। হায় হায়! এবার কি হবে! পুণ্য করে ঘরে ফিরবো, অথচ গঙ্গাজল ছাড়া! এ আবার হয় নাকি! উপায় করলাম আমরাই। আমাদের নিজেদের জন্য আনা ত্রিবেণী সঙ্গমের জলের বেশকিছুটা বোতলে ভরে দিলাম মিলনরানী দেবীকে। অমৃতের পাত্র হাতে নিয়ে হাসি মুখে গাড়ি থেকে নামলেন মিলনরানী দেবী। তখন তার আর তর সইছে না। অথচ সাবধান তো হতেই হবে। কারণ মাঝে আস্ত চারলেনের জাতীয় সড়ক। ঝড়ের গতিতে ছুটছে গাড়ি। হাত ধরে রাস্তা পার করালাম আমরা। মাঝের উঁচু ডিভাইডার পার করালাম রীতিমতো পা ধরে উঠিয়ে। অবশেষে রাস্তা পেরিয়ে স্বামী, সঙ্গী-সাথী ও বাসের দেখা পেলেন মিলনরানী দেবী। জড়িয়ে ধরলেন স্বামীকে। কেঁদে ফেললেন দুজনেই। স্বামী বলে উঠলেন “আমি আমার জীবন ফিরে পেলাম”! পাশ থেকে আমার এক সাথী বলে উঠলেন “এই জীবনকে ফেলেই তো চলে যাচ্ছিলেন মশাই”। উত্তর অবশ্য তার পেলাম না। হাতের ইশারায় চুপ করালাম সাথীকে।

অবশেষে খুঁজে পেয়ে দু’জনাকে মিলিয়ে দেওয়া গেল! স্বামী গৌরচন্দ্র সরকারের সঙ্গে মিলনরানী দেবী। ছবি: লেখক

এর পর এল ধন্যবাদ প্রাপ্তির পালা। সকলের কাছ থেকে অকুন্ঠ ধন্যবাদ পেলাম। কিন্তু যার বাক্য শোনার প্রতিক্ষায় তখন আমি, তা এলো কিছুক্ষণ পর। কান্না মুছে মিলনরানী বললেন “ধন্যবাদ তোমাদের। তোমরাই আজ আমার কাছে সাক্ষাৎ ভগবান”। তখন আমাদের সকলেরই হৃদয়ে আনন্দাশ্রু বর্ষিত হচ্ছে৷ স্বামীর কাছে ফিরলেন “মিলনরানী”। জানিয়ে দেওয়া হল সকলকে। জানলেন ওসি, বিডিও, এসপি, অভিষেক স্যার। জানলেন সাবাই৷ মিলনরানী দেবীর ছেলেকেও একবার জানাতে চেয়েছিলাম। ফোন ওঠেনি। আজ অবধি কলব্যাকও আসেনি। মিলনরানী দেবীকে বাসে উঠিয়ে গাড়িতে উঠে ধাবায় ফিরলাম আমরা৷ মনে তখন তৃপ্তির ছোঁয়া। ছোটবেলা থেকেই শুনেছি কুম্ভ মেলায় হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। কিন্তু “মিলনরানী” ফিরলেন। ঈশ্বর এই অধমের হাত দিয়েই সেই অসাধ্য সাধন করিয়ে নিলেন। করলেন তিনিই। করালেনও তিনি। শুধুমাত্র আমরা জীবনের উপন্যাসে একটি অধ্যায় হয়ে রইলো এই কাহিনী। মহাকুম্ভ আসলেই একটি মিলনমেলা। যেই মেলায় আসমুদ্রহিমাচল মিলে মিশে একাকার। সেই “মিলনতীর্থ”-এ স্মৃতি হয়ে রইলেন “মিলনরানী”।

“মহাকুম্ভ-২০২৫” কে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় সরকার এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রচারের কোনও কমতি ছিল না ৷ সরকারের আহ্বানে যে কাজ হয়েছে তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। যেভাবে গড়ে প্রতিদিন দেড় কোটি ভক্তের আগমন কুম্ভ মেলায় হয়েছে, এমন আর কোনও সমাবেশের উদাহরণ গোটা বিশ্বে স্থাপন করা যাবে কিনা সন্দেহ। মহাকুম্ভে উপস্থিতি সংখ্যা হার মানিয়েছে ভারত, চিন বাদ দিয়ে বিশ্বের সকল দেশের জনসংখ্যাকে। কে আসেনি কুম্ভস্নানে! সেলিব্রিটি, ত্রিকেটার, সিনেমা তারকা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পপতি, মাল্টি-ন্যাশনাল ব্রান্ডের মালিক, তাদের স্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, দেশের শীর্ষ পদাধিকারী, রাজ্যগুলির শীর্ষ পদাধিকারী থেকে সাধু, সন্ত,নাগা এবং কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। এই বিপুল মাস-ম্যানেজমেন্টের জন্য কতটা প্রশংসার যোগ্য উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকার! আর কতই বা ত্রুটি ব্যবস্থাপনায়! সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই প্রশংসা। যে বিপুল জনসমাগম মেলায় হয়েছে, তার সমতুল ব্যবস্থাপনা করা এক কথায় অসম্ভব। তারমধ্যে মেলা চত্বরকে যেভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে, তা অভাবনীয়। কোটি কোটি ভক্তের স্নানের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্য ১২ কিমি দীর্ঘ ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘাটে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। নদীবক্ষে কেউ যাতে বিপদসীমা অতিক্রম না করতে পারে তারজন্য রয়েছে শক্তিশালী ব্যারিকেড। গোটা মেলা চত্বরে পিচ্ছিল মাটিতে বিপদ এড়াতে পাতা হয়েছে খড়৷ নদী বক্ষকে ড্রেজিং করে সমান করা হয়েছে। যাতে হঠাৎ করে কেউ বেশি জলে গিয়ে ডুবে না যায়। নদীতে নামার পথ সুগম করতে বালির বস্তা দিয়ে ঘাট বাঁধাই করা হয়েছে। পুণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য ২৫ টি সেক্টরে গোটা মেলাকে ভাগ করে ৩০ টি পিপ পুলের মাধ্যমে নদীর এপার ওপার যাতাযাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে গোটা মেলা চত্বরকে ডিজিটালি সাজিয়ে তোলা হয়েছে। সনাতন ধর্মের প্রসার ও প্রচারের স্বার্থে অনেক ডিজিটাল উপস্থাপন কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷

অসংখ্য তাঁবু এবং সাধারণ পুণ্যার্থীদের জন্য টেন্ট স্থাপন করা হয়েছে৷ মেলা চত্বরে সাধারণ পুণ্যার্থীদের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে অসংখ্য ভাণ্ডারা চালু করা হয়েছে। যাতে সকলের বিনামূল্যে খাবারের সুবিধা পান। মেলা চত্বরে প্রতিটি ঘাটে মহিলাদের পোশাক বদলের স্থান করা হয়েছে অসংখ্য। শৌচকর্মে যাতে বহু মানুষের একসাথে সমস্যা না হয়। তাই অসংখ্য টয়লেট স্থাপিত হয়েছে অস্থায়ীভাবে। গঙ্গাবক্ষে দূষণ আটকাতে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে গঙ্গাবক্ষে থাকা পূজা সামগ্রী দ্রুত তুলে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে পুলিশি ব্যবস্থা। মোতায়েন রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ড্রোন এবং হেলিকপ্টারেও চলছে নজরদারি। কাজ করছে পুলিশ কুকুরও। জরুরিভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন রয়েছে সর্বত্র। ফায়ার ফাইটিং ভ্যান নজরে এসেছে প্রচুর। সঙ্গম ঘাট বাদ দিয়ে বাকি মেলা চত্বর পরিস্কার ও নির্মল একথা বলাই যায়।

প্রশংসা যেমন থাকবে তেমনি ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও স্বীকার করতেই হবে। অন্যথায় সত্যকে অস্বীকার করা হবে। গোটা মেলা চত্বরের সবচেয়ে বড় ত্রুটি “লস্ট অ্যাণ্ড ফাউন্ড সেন্টার”-কে অ্যক্টিভ না করা। এতবড় মেলা, দেশের দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন। তাদের মধ্যে বহু মানুষ হারাবেন এটাই স্বাভাবিক। গোটা মেলা চত্বরে সাজানো গোজানো “লষ্ট অ্যাণ্ড ফাউন্ড সেন্টার” নজরে এসেছে মাত্র একটি। যেটি সেক্টর ৩ এ মিডিয়া সেন্টারের পাশে অবস্থিত৷ অথচ মেলার বিস্তার ৪০০০ হেক্টর। এই ধরনের সেন্টার প্রতি ৫০০ মিটারে একটি করে প্রয়োজন ছিল। এই সেন্টার অ্যাক্টিভ থাকলে মিলনরানী দেবীর মতো হয়তো আরও বহু পুণ্যার্থীকে হারিয়ে গিয়ে চূড়ান্ত বিরম্বনায় পড়তে হতো না।

মেলা জুড়ে যে পরিমাণ “মে আই হেল্প ইউ কর্নার” হওয়া উচিত ছিল। তার তুলনায় ছিল নগন্য। হাতেগোনা যেকয়টি ছিল সেগুলিতেও প্রশিক্ষিত কর্মী বা পুলিশ ছিলেন না। সেন্ট্রাল মাইকিং সিস্টেম ছিল এককথায় ‘অকাজের’। যে পুলিশরা মেলায় মোতায়েন ছিল তাদের বেশিরভাগই মেলার কিছুই চেনেননা৷ মেলা শুরুর আগে তাদের রাজ্যের দূর-দূরান্ত থেকে নিয়ে আসা হলেও মেলা ঘুরিয়ে চেনানোর মতো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। মাইকিং ব্যবস্থার ব্যর্থতাই “ভাগদর” (পদপৃষ্ঠের ঘটনা) এর জন্য দায়ী বলে স্থানীয় অনেকেই মনে করেন। পুলিশ যেমন মেলা চেনেন না, ঠিক তেমনই মেলা চেনেননা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরাও। ফলে সাধারণ জনগণের অবস্থা সহজেই অনুমেয়৷ আমাদের রাজ্যে যে কোনো বড় উৎসবে রুট ম্যাপ প্রকাশ হয়৷ “গঙ্গাসাগর মেলা গাইড” প্রতি বছর বের হয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার এই ধরনের কোনো গাইড ম্যাপ বের করেছে বলে জানিনা। গুগুলে বা সমাজমাধ্যমে সেক্টর লিখে একটি ম্যাপ ছড়ালেও তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। দূর-দূরান্তের মানুষ তো ছাড় স্থানীয় মানুষও সেক্টরের নাম ধরে কোনটা কোন জায়গা তা চিনতে পারবে না। প্রয়োজন ছিল একটি বিস্তারিত রুট ম্যাপ ও গাইডবুক প্রকাশ করা। সেই ম্যাপ মেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করা উচিত ছিল। যাতে কেউ দিক ভ্রষ্ট না হয়। ম্যাপের ছোটো ছোটো লিফলেট তৈরি করে তা “মে আই হেল্প ইউ কর্নার”-এ দেওয়া উচিত ছিল৷ এগুলির কিছুই হয়নি৷

মহাকুম্ভের ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতিগুলি চোখে পড়েছে, সে’সবের উল্লেখ করতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। ছবি: লেখক

মেলায় বিভিন্ন ভাষা জানা দক্ষকর্মীদের দিয়ে ক্যাম্প করা প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যের সরকারগুলির জন্য ক্যাম্প করে তাদের প্রতিনিধি বসালে হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ সহজে পাওয়া যেত৷ অন্য রাজ্যের ক্যাম্প চোখে পড়েনি৷ মেলায় স্নানের জায়গা ১২ কিমি হলেও সকলেই সঙ্গম ঘাটে স্নান করতে উদগ্রীব। তা আটকাতে কোনো প্ল্যান সরকারিস্তরে ছিল না। বরং বোর্ডে বারংবার সঙ্গমঘাটের দিক নির্দেশ করে ভিড়কে একটি দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মেলার ভেতরে ভিড় নিয়ন্ত্রণে ভিড়কে ভাগ করে দেওয়া হয়নি৷ যে যার খুশি মতো যাওয়া আসা করছে মেলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য শুধুমাত্র ” পিপ পুল” ভাগ থাকলেও মেলার বাকি অংশে অবাধ যাতায়াত বিপদ বাড়িয়েছে৷

সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি করেছে ভিআইপি যাতায়াত। যেখানে মেলাস্থলের বহু কিমি আগে থেকে সাধারণ মানুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাইকে হেঁটে যেতে হচ্ছে, সেখানে ভিআইপিরা চূড়ান্ত ভীড়ের মধ্যে একাধিক গাড়ি পাইলট, এসকর্ট নিয়ে গোটা মেলা দাপিয়ে বেরিয়েছে। আর সাধু সন্ত হলে তো কথাই নেই। ঢাক, ঢোল৷ মাইক, ট্রাক্টর, জেসিবি সব নিয়ে দল বেঁধে চূড়ান্ত ভীড়ে তারা প্রবেশ করেছে। তাদের দর্শন পেতে চূড়ান্ত হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি! আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই গোটা কর্মকাণ্ড ইচ্ছেমতো করতে দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। এক কথায় যেচে বিপদ ডেকে এনেছে তারা। মেলা পরিচালনার আর একটি বড় ত্রুটি ছিল স্থানীয় ক্লাব, সংগঠন, এনজিওদের যুক্ত না করা। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনেক এগিয়ে। গঙ্গাসাগর মেলায় ১৭৯ টি এনজিওকে ব্যবহার করে রাজ্য সরকার। যেখানে ভারত সেবাশ্রম সংঘ এবং ইস্কনের ভূমিকা প্রশংসার দাবী রাখে। স্থানীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবকের ঘাটতি মেটানো হয়। পুলিশের চাপ কমে। স্থানীয় মানুষের উপস্থিতির কারণে সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে জনগনকে গাইড করতেও সুবিধা হয়। এক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।

মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন খাদ্য, শৌচকর্ম, স্নান ইত্যাদি। শেষদুটির ব্যবস্থা থাকলেও খাদ্যের বিষয়ে মেলা কর্তৃপক্ষ উদাসীন। এতবড় মেলা চত্বরে খাবারের দোকান হাতে গোনা। সেক্টর ৩ এ বেশ কিছু ভালো খাবারের দোকান থাকলেও, বাকি মেলায় তা চোখে পড়েনি। ডাল-চাওলের দোকানের দেখা পাওয়া ছিল কষ্ট কল্পনা। অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে ফুচকা, ঘুগনি, ফ্রুটজুস,চা শসা ইত্যাদির দেখা মিললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সর্বত্র এমআরপি থেকেও দ্বিগুন দাম জিনিসের। সবচেয়ে বেশি গলা কাটছে ব্রান্ডেড কোম্পানির আউটলেটগুলি। কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো ভাবনাই নেই। একটি জলের ড্রাম, যার বাজার দর ১০-১৫ টাকা। সেটি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৫০ টাকায়। এক কাপ চা অনেকক্ষেত্রেই ৫০ টাকা। জলের বোতল ৫০ টাকা। কোকের বোতল ৩০ এমআরপি, কিন্তু বিকোচ্ছে ৫০ টাকায়৷ ট্রেট্রাপ্যাকে মাজা এমআরপি ২০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। এক গ্লাস লস্যি ১০০ টাকা, এমন কত কি! দেখার কেউ নেই।

এবিষয়েও এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। গঙ্গাসাগর মেলায় নকুলদানা থেকে দুপুরের মিল সবকিছুর দাম ঠিক করে দেয় রাজ্য সরকার এবং সেটি বারংবার ঘোষনাও করা হয়। স্থানে স্থানে রেট লিখে সচেতনতার পোস্টারিংও করা হয়। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সর্বপরি মেলার মাহাত্ম্য প্রচার এবং আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যতটা উদ্যোগী ছিল কেন্দ্র বা উত্তরপ্রদেশ সরকার, তার সিঁকি ভাগও নিরাপত্তা এবং মাস-ম্যানেজমেন্টে ব্যয় করেনি তারা।

আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে এতবড় আয়োজনের ত্রুটি দেখা ঠিক না বেঠিক তা আমি জানিনা। কিন্তু নিজের বিবেকের সাথে অন্যায় করা উচিত নয়। যা দেখেছি তার নিরপেক্ষ বর্ননা ভবিষ্যতে আরও ভাল ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন। তাই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কাওকে রাজনৈতিকভাবে খুশি বা দুঃখী করার কোনও দায় আমার নেই। হয়তো এই ত্রুটিগুলি আগেই কাটিয়ে ওঠা গেলে অনেক বিপর্যয় আটকানো গেলেও যেতে পারতো! হয় তো!

চলবে…

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও উপস্থাপক হিসেবে শুরু। এখন সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা। প্রকাশ ফাউন্ডেশনের রাজ্যসভাপতি। মহাকুম্ভ থেকে ফিরে নিজের উপলব্ধির কথা জানাচ্ছেন। যা একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *