গানবাজনায় নাখোশ তৌহিদী জনতা, ঢাকায় বাতিল নাট্যোৎসব! বাংলাদেশ জুড়ে বন্ধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

গানবাজনায় নাখোশ তৌহিদী জনতা, ঢাকায় বাতিল নাট্যোৎসব! বাংলাদেশ জুড়ে বন্ধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান


নাটকে ঈমান নষ্ট তাই নাট্যোৎসব বন্ধ!

‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’ নাটকের একটি বড়সড় বাৎসরিক উৎসব। এ’বছর বাংলাদেশের ৮৫টি গ্রুপ থিয়েটারের উৎসবে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। দুই মাস ধরে উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছেন আয়োজকেরা। শনিবার ( ১৫ ফেব্রুয়ারি) থেকে ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’ শুরু হ‌ওয়ার কথা ছিল। টানা ১৩ দিন ধরে উৎসব চলত। কিন্তু শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে চড়াও হয়ে উৎসব বন্ধের দাবি জানায় একদল জনতা। নাট্য উৎসব চললে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট হবে বলে আপত্তি তোলে তারা। নাট্য উৎসব বন্ধ না করা হলে হামলা করে তা পন্ড করে দেওয়া হবে বলে আয়োজকদের হুঁশিয়ারি দেয় তৌহিদী জনতা।

নিরাপত্তা চেয়ে নাট্য উৎসব উদযাপন পরিষদের সদস্যরা রাতে রমনা থানার দ্বারস্থ হলে থানার ওসি তাঁদের উৎসব স্থগিত করে দিতে বলেন। উদযাপন পরিষদের লোকেরা থানা থেকে বেরিয়ে যেতেই কয়েক শত জনতা থানায় ঢুকে ওসিকে গালিগালাজ করা শুরু করে। পুলিশ নাট্য উৎসবের অনুমতি দিলে কিম্বা অনুষ্ঠানস্থলে কোন‌ও রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে পরিণতি খারাপ হবে বলে ওসিকে শাসানি দেয় তৌহিদী জনতা।

তৌহিদী জনতার হুমকির মুখে বাতিল ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’। উৎসব বন্ধ রাখতে চাপ দিয়েছে পুলিশ‌ও! সংগৃহীত ফটো।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে নাট্যোৎসব বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় উৎসব উদযাপন পরিষদ। পরিষদের সদস্য সচিব কামাল আহমেদ সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের জানান, “পুলিশ নিজেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, তারা আমাদের নিরাপত্তা দেবে কী!” তৌহিদী জনতা যে এ’বারে নাট্যোৎসব হতে দেবে না, আগাম খবর ছিল পুলিশের কাছে। শনিবার সন্ধ্যায় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে চড়াও হয়ে উৎসব বন্ধের দাবি জানায় জনতা। দুপুরেই উৎসব বন্ধ করতে মহিলা সমিতির সদস্যদের কাছে রমনা থানা থেকে ফোন আসে। তৌহিদী জনতা থানায় জানিয়েই মহিলা সমিতি মিলনায়তনে চড়াও হয়েছিল বলে ধারণা করছেন ঢাকা মহানগর নাট্য পরিষদের কর্মকর্তারা। বেশি রাতে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে কয়েকজন ঢুকে উৎসবের পোস্টার, ব্যানার ও সাজসজ্জা নষ্ট করে। সেই সময় ঘটনাস্থলের ধারেকাছে কোন‌ও পুলিশ ছিল না।

বসন্তোৎসবের আয়োজকরা পালিয়ে বাঁচলেন উত্তরায়

গত বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরায় তৌহিদী জনতার চাপে বন্ধ হয়েছে বসন্তোৎসব। অনুষ্ঠান শুরু হ‌ওয়ার মুখে একদল লোক চড়াও হয়ে গানবাজনা বন্ধ করার দাবি তোলে। গায়ে হাত পড়ার আগেই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেন আয়োজকরা। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে বাঁচেন শিল্পীরা। এই দুই ঘটনার পরে ঢাকা শহরে বসন্তোৎসব সহ একাধিক পূর্ব নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছে ভীত-সন্ত্রস্ত আয়োজক সংস্থাগুলি। অন্যান্য বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ঢাকা শহরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ধূম পড়ে যায়। এ’বছর খোদ ঢাকা মহানগর পুলিশ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকতে আয়োজকদের নিরুৎসাহিত করছে।

৫ অগাস্টের পর থেকেই বাংলাদেশ জুড়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে। কয়েক মাস আগে ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি গোষ্ঠীর হামলায় মাঝপথে নাটকের ‘শো’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চে জনতার ছোঁড়া ইট-পাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ। রাজধানী ঢাকাতেই যখন এই পরিস্থিতি, তখন দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মীরা কী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, তা বলাই বাহুল্য।

চট্টগ্রাম থেকে টাঙ্গাইল- একের পর এক অনুষ্ঠান পন্ড

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। গান-বাজনা আয়োজনের খবর পেলেই সেখানে চড়াও হচ্ছে তৌহিদী জনতা। তাদের হুমকির মুখে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছেন আয়োজকরা। মহম্মদ ইউনূসের পুলিশ হাত তুলে নিয়েছে। শনিবার চট্টগ্রামের সিআরবি মাঠে বসন্তোৎসবের আয়োজন করেছিল আবৃত্তি সংগঠন ‘প্রমা’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান করতে পারে নি সংগঠনটি। মাঠটি রেলের। প্রমাকে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিয়েও একটি গোষ্ঠীর চাপে তা প্রত্যাহার করে নেয় চট্টগ্রাম রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

তৌহিদী জনতার মিছিল। বাংলাদেশ জুড়ে এখন ইসলামপন্থী দলগুলির দাপট। খোদ ঢাকা শহরে আতঙ্কে সাংস্কৃতিক কর্মীরা। ফাইল ফটো।

গত ছয়মাসে বাংলাদেশ জুড়ে তিনশোর বেশি মাজার ভাঙা হয়েছে। লালন সাঁইয়ের দেশে বাউলদের একাধিক আখড়া আক্রান্ত। টাঙ্গাইলের মধুপুর বাসস্ট্যান্ড চত্বরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি লালন স্মরণোৎসব হ‌ওয়ার কথা ছিল। হেফাজতে ইসলামের সদস্যদের বাধায় বাউলদের সেই অনুষ্ঠান পন্ড হয়ে যায়। প্রত্যেকটি ঘটনায় পুলিশ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। অনুষ্ঠান ঘিরে কোন‌ও ঝামেলা হ‌ওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই স্থানীয় থানার ওসিরা উল্টো আয়োজকদের উপর অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত করে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন।

মুহাম্মদ ইউনূসের জামানায় বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম নির্ভয়ে সব ধরণের সংবাদ প্রকাশ করতে পারছে বলে ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের দাবি। অথচ তৌহিদী জনতার হুমকিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হ‌ওয়ার সংবাদগুলি চেপে যাচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ মূল ধারার গণমাধ্যম।

Feature graphic is representational and designed by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *