জড়ের মধ্যে চেতন বা চৈতন্যের বিকাশ হলে সেই অবস্থাকেই বলে প্রাণ। যে চৈতন্যের সংশ্লেষে জড়ের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার, সেই পরম চৈতন্যকে লাভ করাই ভারতীয় তন্ত্রের মূল কথা। তন্ত্রই হল ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের ভরকেন্দ্র। আবার তন্ত্রের ভরকেন্দ্রে যে পরম সত্ত্বা স্থিত তাঁর নামই হল ‘শিব‘। আমাদের তন্ত্রের অভীষ্ট হল জীব চৈতন্যের সঙ্গে পরম চৈতন্যের যোগসূত্র স্থাপন।
শিব কে ? শিব কী ? অজস্র রূপক, বিভিন্ন পুরাণ, শতশত লোককথা, পৌরাণিক নানা কাহিনী এবং বিপুল শাস্ত্রাদির জটিল সব অলিগলি পার করে শিবের কোনও একক সংজ্ঞায় পৌঁছানো কার্যত দুষ্কর। শুদ্ধ ভক্তের অবশ্য সেই চেষ্টার দরকারও নেই। ভক্তের চোখে ভগবান শিবের সহস্র রূপ আর অনন্ত মহিমা। সনাতন ধর্মে জ্ঞানমার্গে সাধন যতটা কঠিন ভক্তিমার্গে ততটাই সহজ। আমাদের শাস্ত্র ইষ্টকে ভালোবাসার প্রশ্নে ভক্তকে নিরঙ্কুশ অধিকার দিয়েছে। ভক্তের আব্দার মেটানোয় বিষ্ণুর চাইতে শিব কিছু কম নন। তিনি তো আবার আশুতোষ। অল্পতেই তুষ্ট। স্রেফ ভক্তের কথাতেই ভুলে গিয়ে তাঁর সকল ইচ্ছা পূরণ করেন বলেই তো তিনি ‘ভোলেবাবা‘।
ব্রহ্মকেই জগতের আদি কারণ, উৎস ও পরম চৈতন্য বা ‘সুপ্রিম কনশাসনেস’ হিসেবে বর্ণনা করেছে উপনিষদ। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে শিবের স্বরূপকেই পরম ব্রহ্ম বা পরম চৈতন্য বলা হয়েছে। ‘ ‘যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ‘– অর্থাৎ তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ। তিনি স্বরূপে বর্তমান। সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি। তিনি তুরীয়, অন্ধকারেরও অতীত এবং অনাদি ও অনন্ত।
ভগবান শিবের ১০৮টি নাম । তার মধ্যে ‘শিব‘ নামের তাৎপর্যই সর্বাধিক। শিব মানেই জীবের চৈতন্যের আধার, অনাদি, অনন্ত, শাশ্বত পরমব্রহ্ম। শিবকে বলা হয় জগতের পরম মঙ্গলময় পরমেশ্বর। যে শক্তি থেকে জগতের সমস্ত জীব চৈতন্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তার অধিক মঙ্গলময় আর কে হতে পারেন ?
স্থূল জগতকে সঞ্চালনা করেন শিবেরই অধীনস্থ শক্তি মহামায়া। স্থূল জগতের ঊর্ধ্বে যে চিৎ জগত, মায়ার বন্ধন কাটিয়ে জীবাত্মাকে তাতে উত্তরণ ঘটানোই শিবের লক্ষ্য। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় কালের ত্রি অবস্থা। কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তিনি কালাতীত। সত্ত্ব-রজ-তম প্রকৃতির ত্রি গুণ। তিনি সকল গুণের ঊর্ধ্বে । তাই তিনি গুণাতীত। তিনি মহাযোগী। কারণ জীবনের সুরের সঙ্গে তিনি জগতের সুরকে যুক্ত করেন।
শিব নিত্য ধ্যানমগ্ন। কারণ তিনিই সৎ-চিৎ-আনন্দ– সচ্চিদানন্দ। শিব ও শক্তি এক, অভেদ ও অবিভাজ্য। শিব স্থির, অচঞ্চল, ধ্রুব। শক্তি অস্থির, চঞ্চল ও গতিময়। স্থিতি ও গতি এই দুই নিয়েই জগৎ। চৈতন্য একই সঙ্গে ধ্রুব ও চঞ্চল। জগতের হেতু বা আদি যে পরম চৈতন্য তাঁকে অনুভব করার রাত্রিই মহাশিবরাত্রি। ওম নমহঃ শিবায়।
এই লিঙ্কে ক্লিক করে শিব মাহাত্ম্যের ভিডিওটি দেখুন 👇