গৌরব সরকার: আমরা বাঙালি। ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া জাত আমরা। পৃথিবীর খুব কম জাতিই মাতৃভাষার জন্য মৃত্যু বরণ করেছে। বাঙালি বাংলার জন্য বাহান্নয় রক্ত দিয়েছে ঢাকায়। একষট্টিতে রক্ত দিয়েছে শিলচরে। আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে খোদ জাতিসংঘ। পৃথিবীর ধ্রুপদী ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা অন্যতম। বিশ্বের শীর্ষ দশটি ভাষার মধ্যে বাংলা সপ্তম। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাঙালি। ভালবাসার ঋতু বসন্ত। বসন্তেই বাংলাকে ভালবেসে জীবন উৎসর্গ করেছিল বাঙালি।
যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, সেই ভাষা আমাদের। যে ভাষা জীবনানন্দ-নজরুলের সেই ভাষাই আমাদের। যে ভাষা মানিক-বিভূতি-শরৎ-তারাশঙ্করের, সেই ভাষারই উত্তরাধিকারী আমরা। বাংলা ভাষার একটি সুন্দর অতীত আছে। কিন্তু ভবিষ্যত? বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কি আলোকজ্জ্বল? বর্তমান পরিস্থিতি তো তা বলছে না। আসলে ভাষাকে বহন করে মানুষ। একটা ভাষা যত বড় ধ্রুপদীই হোক, মানুষ যদি ভাষাটিকে ত্যাগ করে, তবে সেই ভাষার মৃত্যু ঠেকায় কে। ভাষা বাঁচে মানুষের বাচনে, মানুষের শ্রবণে, মানুষের মননে, মানুষের পঠনে এবং মানুষের লেখনীতে। ভাষা বাঁচে হাটে-বাজারে এবং কাজের জগতে।
বাঙালি যদি বাংলা ভাষার যত্ন না করে তবে বাংলাকে যত্ন করবে কে? বাঙালি যদি বাংলা ভাষায় কথা না বলে তবে বাংলা ভাষায় কথা বলবে কে? বাঙালির সন্তান যদি বাংলা বর্ণমালাই না চেনে তবে বাংলা পড়বে কে? বাঙালির ছেলেমেয়েরা যদি বাংলা লিখতেই ভুলে যায়, তবে অনাগত ভবিষ্যতে আ-মরি বাংলা ভাষায় লিখবে কে?
বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি পড়ুয়াশূন্য হচ্ছে। বাঙালির সন্তান বাংলা ভাষা ভুলে গেলে বাংলা ভাষায় লিখবে-পড়বে কারা? সংগৃহীত ছবি
বাঙালি মধ্যবিত্ত বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাংলা মাধ্যমে পড়লে ভবিষ্যৎ অন্ধকার- এই আতঙ্কে ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পাঠাচ্ছে বাঙালি। শুধু বাংলা শিখে কাজ পাওয়া যায় না- এ কথা তো মিথ্যে নয়। তাই, দিনে দিনে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। বহু বিখ্যাত বাংলা মাধ্যম স্কুলের ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার দশা।
‘জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না’- বলতে আমরা সত্যিই গর্ব অনুভব করি। বাঙালির ঘরের ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে গেলে চোখে সর্ষেফুল দেখে। ঘরে ঘরে এমন বঙ্গসন্তানের অভাব নেই, যারা একবর্ণ বাংলা লিখতে পারে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্রবহীন একটা বিরাট বাঙালি প্রজন্ম আমাদের চোখের সামনেই তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে।
ভালবাসলে যত্ন নিতে হয়। ভালবাসলে ধারণ করতে হয়। সামাজিক মাধ্যমে, পথেঘাটে ভুল বাংলা বানানের ছড়াছড়ি। ভুল বাংলা লিখে বাঙালি আর লজ্জিত হয় না। অশুদ্ধ উচ্চারণ নিয়েও বাঙালির মাথাব্যথা নেই। বাংলাভাষা ভালবাসলে আমরা কি একটু সাবধানী হতাম না? দিনের শেষে ভাষাকেও চালায় অর্থনীতি। মানুষ বড্ড কেজো এবং হিসেবি। যে ভাষা শিখলে কাজ পাওয়া যায়, মানুষ ঠ্যালায় পড়ে সেই ভাষা শিখতে বাধ্য হয়। বাংলা পড়লে ভাত নেই, বাঙালির মনে এই ভয় চেপে বসেছে। তাই নিজের মাতৃভাষাকে বাঙালির এত অনাদর, অবহেলা। বাঙালির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিও রক্ষা পাবে।
বাঙালিমুসলমান ঈমান রক্ষা করতে বাঙালিত্ব ত্যাগ করতেও প্রস্তুত! সংগৃহীত ছবি
৫ অগাস্টের পর থেকে ভাষা আন্দোলনের দেশ বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদীদের দাপাদাপি। গান-বাজনার আসরে তৌহিদী জনতার আক্রমণ। বাউলেরা গণপ্রহৃত। বাঙালিমুসলমান ঈমান রক্ষা করতে বাঙালিত্ব ত্যাগ করতেও প্রস্তুত। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সসম্মানে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব এ’পারের বাঙালিকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে।
ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাস। এই মাসেই অনন্তের উদ্দেশ্যে ডিঙা ভাসালেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। অতুল বাংলাকে কীভাবে ভালবাসতে হবে, প্রতুলের বিখ্যাত গানের প্রতিটি ছত্রে তা বলা আছে-
বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুকআমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ॥