মহাকুম্ভ তুলনা রহিত। অকল্পনীয় ভিড়। হট্টগোল। ঠেলাঠেলি। পথের ক্লান্তি। ধুলোবালি। কিন্তু ডুব দিলেই প্রশান্তি! অমৃত কি জলে? না! অমৃত উপলব্ধিতে। মহাকুম্ভ থেকে কেউ খালি হাতে ফেরে না। অমৃতকুম্ভ থেকে ফিরে জানাচ্ছেন নব্যেন্দু মৌলিক–
যে মেলা বা ধর্মীয় সমাগমের দিকে নজর গোটা বিশ্বের। যে বিশাল আয়োজন ভারতের প্রতিটি প্রান্তকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তাতে উপস্থিত হব না এমনটা হতেই পারে না। যদিও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও কুম্ভমেলা সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্যই আমার কাছে ছিল না। অবাক করা হলেও এ’কথা একেবারে সত্য। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার হঠাৎ বেনারস যেতে খুব ইচ্ছে হলো। বাড়িতে আলোচনা সারলাম। কিন্তু তখনও কুম্ভের কথা ভাবনাতেও নেই। ভাবলাম ফেব্রুয়ারিতে বেনারস যাব। ঠিক এই ঘটনার একদিন পর আমার বন্ধু তথা প্রকাশ ফাউন্ডেশনের সদস্য শুভজিৎ ধর আমাকে বলল, চলো কুম্ভমেলায়। ওর কাছেই কুম্ভ সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য জানলাম। আরও দুজনকে কুম্ভে যেতে অনুরোধ করলে তারাও রাজি হয়ে গেল। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। সেই রাতে বাড়ি ফিরেই শুরু হল কুম্ভ নিয়ে পড়াশোনা। যত বেশি করে কুম্ভের উপর ধ্যান দিতে থাকলাম, ততই আকর্ষণ বাড়তে থাকলো তীর্থরাজ প্রয়াগে যাওয়ার। বলা ভাল, একদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যাই হয়ে যাক এই সুযোগ মিস করা যাবে না। যেতেই হবে কুম্ভ মেলায়।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ট্রেনের টিকিট কাটা হল। প্রথমে আমাদের রওনা দেওয়ার তারিখ ঠিক হলো ২০ শে জানুয়ারি। কিন্তু সেই টিকিট বাতিল করতে হল। সামান্য ওয়েটিং টিকিট যখন কনফার্ম হল না, ততক্ষণে আমরা বুঝে গিয়েছি ট্রেনে যাওয়া অসম্ভব। যত দিন যাবে কুম্ভ নিয়ে মানুষের উন্মাদনা ততই বাড়বে। সুতরাং অন্য ব্যবস্থা করাই ভাল। ঠিক হল ছোটো গাড়ি ভাড়া করেই কুম্ভে যেতে হবে। গাড়িও ঠিক হল। শুভঙ্কর পাল নামে এক গাড়ির চালক দাদা সারা বছর আমাদের সংগঠনের প্রয়োজনে গাড়ি পরিষেবা দেন। তিনি আমার পাড়ার বাসিন্দা এবং প্রকাশ ফাউন্ডেশনেরও সদস্য। ফলে তার গাড়ি নেওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে বলে মনে করে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেললাম। যাবার দিন ঠিক হয়েছিল ১০ই ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ২৯ শে জানুয়ারি মৌনী অমাবস্যার ঘটনা সকলের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিল। যদিও আমি বিন্দুমাত্র আতঙ্কিত হইনি। যখন ঠিক করে ফেলেছি কুম্ভে যাব, তখন প্রতিকূলতা যাই আসুক যেতে আমাকে হবেই। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু ভিড়ের কথা মাথায় রেখে, যাতে কিছুটা আগাম প্রয়াগরাজ পৌঁছে যাওয়া যায়, তাই আমাদের সফরসূচি এগিয়ে নিয়ে আসা হল। ১০ এর বদলে ৯ ই ফেব্রুয়ারি আমাদের রওনা হওয়ার দিন ঠিক হল। সবই যখন ঠিকঠাক, তখন বাধসাধলো দুই সঙ্গীর সমস্যা। ব্যাক্তিগত সমস্যার কারণে দুই সাথী মেলায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। চারজনের আসন থাকা গাড়িতে দুজন গেলে খরচ অনেক বেশি। এই অবস্থায় আমার এবং শুভজিতের মন ভাঙতে লাগল। কীভাবে এই চাপ নেওয়া যাবে! কিন্তু শেষে কাজটা ভগবানই করলেন। নতুন দুই সাথী আমাদের সাথে যুক্ত হলেন। এবারে ৯ই ফেব্রুয়ারি দুপুর দুটো নাগাদ দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম আমি, আমার সফরসঙ্গী শুভজিৎ, সপ্তর্ষি এবং সন্টু দা। সাথে আমাদের সারথী শুভঙ্কর। যিনি এই দীর্ঘ পথ আমাদের নিয়ে যাবেন তার গাড়ি চালিয়ে।
মহাকুম্ভের পথে বারাণসীতে বিশ্বনাথের চরণে
মোট ৫ জনের টিম। প্রত্যেকেই যথেষ্ট এক্সাইটেড। গাড়ি বিহারের ঠাকুরগঞ্জ পার হওয়ার পর থেকেই চারিদিকে শুধু কুম্ভের গাড়ির ছড়াছড়ি। অথচও ঠাকুরগঞ্জ থেকে প্রয়াগের দূরত্ব কমপক্ষে ৭৫০ কিমি। সারারাত গাড়ি চলল। মাঝে বিরতি দ্বারভাঙ্গা। সেখানে রাতের খাবার সারলাম আমরা। এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে পৌঁছালাম মহাদেবের নিজের শহর কাশীতে (বারাণসী)। সারারাতের দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত তখন সকলেই। বাইরের শহরের গাড়ি কাশী শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই ‘পিএম পার্কিং’ নামক স্থানে গাড়ি পার্ক করা হলো। এবার ভরসা টোটো। পার্কিং-এর সামনে থেকেই টোটো পাওয়া যাচ্ছে। তারাই হোটেল খুঁজে দিলেন। সেখানে যাবতীয় লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়া বেনারস শহর দেখার জন্য। যে টোটোচালকেরা নিয়ে এসেছিলেন, তারাই আবার পৌঁছে দিলেন ‘নমো-ঘাট’। সেই ঘাট থেকেই দেড় ঘন্টার নৌকা বিহার। গঙ্গাবক্ষে বসিয়ে সকল ঘাট ঘুরিয়ে নামিয়ে দিল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন ঘাটে।

আসলে কাশী শহরটি ঘাটের শহর। সামান্য দূরত্বে এত এত ঘাট যে কোনটি কোন ঘাট তা মনে রাখা বেশ কষ্টকর। দেড় ঘন্টার নৌকাবিহারে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগার বিষয় মণিকর্ণিকা ঘাট। একের পর এক শব দেহ এসেই চলেছে। চিতা জ্বলেই যাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে এই ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকলে জীবন কি! আর মৃত্যুই বা কি! সাংসারিক বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন সবকিছুকেই এক মূহুর্তে তুচ্ছ বলেই মনে হবে। গঙ্গাভ্রমণ শেষে পতিতপাবন, প্রাণ প্রদায়িনী গঙ্গায় স্নানের সুযোগ হারাতে চাইলাম না। স্নান সারলাম। গঙ্গা প্রণাম, সূর্য প্রণাম অন্যান্য দেবতাদের প্রণাম শেষে কাশী বিশ্বনাথের দর্শনের পালা। দিনটি ছিল সোমবার। দৈনন্দিন নিয়ম অনুযায়ী মহাদেবের পূজা না করে আমি অন্ন গ্রহণ করি না। এদিকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের লাইন দূর থেকে দেখে আমার বুঝতে বাকি নেই,ওই মন্দিরে পূজা দেওয়া এককথায় অসম্ভব৷ তাই আগে ভাগেই গঙ্গার ঘাটে থাকা শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল চরিয়ে ফুল ও অন্যান্য উপাচারে পূজা সারলাম। এরপর রওনা হলাম কাশী বিশ্বনাথের জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনের জন্য লাইনে দাঁড়াতে।

প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে লাইনের শেষ খুঁজে পাওয়া গেল। বুঝতে পারলাম বাবা বিশ্বনাথের দর্শনে দীর্ঘ সময় লাগবে। তাই খাওয়া দাওয়া করে নিতে হবে। প্রথমেই কাশীর বিখ্যাত কেশর দুধ ও দই খাওয়া হল৷ তারপর নিরামিষ খাবার খেলাম। এরপর দাঁড়িয়ে পড়লাম লাইনে। বিকাল ৪ টা থেকে রাত ১১.৩০ অবধি লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আগের সারারাত দুচোখের পাতা এক করিনি। এমন ঘটনা অন্য সময় হলে হয়তো অসুস্থই হয়ে যেতাম। কিন্তু না, ঈশ্বরের স্থানে শরীর খারাপ হতেই দেওয়া যাবে না। হয়তো ঈশ্বরও তাই চান। তাই দীর্ঘ লাইন, তাকে কেন্দ্র করে হুড়োহুড়ি, মারামারি, জুতো-মোবাইল রাখাকে কেন্দ্র করে চূড়ান্ত অব্যবস্থা এমনকি কোনোক্রমে পদপৃষ্ঠ হতে হতে বেঁচে কাশী বিশ্বনাথের দর্শন করলাম। দর্শন? ওই আর কি! সাতঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যেই মাত্র মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে দাঁড়ালাম, তখনই মন্দিরের সেবকরা ধাক্কা দিয়ে ঠেলে বের করে দিলেন। সামান্য চোখের দেখাও দেখতে পাওয়া গেল না গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত বাবা বিশ্বনাথকে। একই অবস্থা প্রায় সকলেরই। অথচ বাইরে লাইন ভেঙে লোক ঢোকানো, জুতো মোবাইল রাখাকে কেন্দ্র করে যে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, সেখানে যে কোনও মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সে’বিষয়ে কারও নজরই নেই। উদাসীন পুলিশ সবকিছু দেখেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনও পদক্ষেপই করছে না। দেখে খুব রাগ হল কর্তৃপক্ষের উপর। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
কাশী ছেড়ে ফের প্রয়াগের পথে
হোটেলে এসে শুনি সময়ের বহু আগেই ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে আমাদের দুই সাথীকে, যারা বিশ্বনাথ দর্শনের লাইনে দাঁড়াতে চান নি। একটু বিশ্রাম নিতে হোটেলে ফিরেছিলেন। তাদের মধ্যে আমাদের গাড়ির চালক শুভঙ্করও আছে। যে সারারাত জেগে গাড়ি চালিয়েছে এবং আগামী রাতও যাকে জাগতে হবে। তারা অবশ্য বিষয়টি আমাকে আগেই জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কাশী বিশ্বনাথ দর্শনে গেলে মোবাইল ফোন বাইরে রাখতে হয়। তাই ফোন আমার থেকে দূরে থাকায় চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। অবশেষে আমরা হোটেলে ফিরে বুঝতে পারলাম, এত লোক সমাগমের সুযোগ নিয়ে চূড়ান্ত অন্যায় করছেন এক শ্রেণীর বেনারসবাসী। তাদের মধ্যে আমাদের হোটেল মালিকও একজন। কথা বাড়ানোর উপায় নেই। বাড়িয়ে লাভও নেই। কারণ বাজারে এখন হোটেল ভাড়া নেওয়ার লোকের কোনও অভাব নেই কাশী শহরে। তাই আমাদের কথা হোটেল মালিকের কানে প্রবেশ করবে না, এটা বলাই যায়। কিছুটা মানসিক পীড়া নিয়েই কাশী শহর ছাড়লাম। মন্দির দর্শন করে বেরিয়েছিলাম রাত ১১.৩০-এ। তাই রাতের খাবারের দোকানগুলি বেশিরভাগই বন্ধ ছিল। যেগুলি খোলা ছিল সেগুলিতেও ছিল প্রচণ্ড ভিড়। ফলে রাতের খাবার না খেয়েই গাড়িতে উঠলাম। এবার গন্তব্য “প্রয়াগরাজ”।
তীর্থরাজ প্রয়াগকে কেন্দ্র করে আমাদের এক্সাইটমেন্ট প্রচুর। বেনারস থেকে প্রয়াগরাজের দূরত্ব প্রায় ১২২ কিমি। যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা। বেনারস শহর ছেড়ে বেশকিছুদূর এগিয়ে জাতীয় সড়কের ধারে একটি ধাবার দেখা পাওয়া গেল। সে’খানেই রাতের খাবার সারলাম। তখন প্রায় রাত ১ টা। এরপর গাড়ি ছুটতে থাকলো প্রয়াগের উদ্দেশ্যে। এই সম্পূর্ণ যাত্রাপথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার একমাত্র উপায় পেট্রোল পাম্প। কিন্তু প্রয়াগগামী রাস্তার প্রতিটি পেট্রোল পাম্পের শৌচাগারেই লম্বা লাইন। অগত্যা আশপাশেই খাল, বিল, মাঠ, নয়ানজুলি সবকিছুই তখন পাব্লিক টয়লেট। মাঠে শৌচকর্ম করার অভিজ্ঞতা আমার আগেও ছিল। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের বেশকিছু জেলায় বেশ কয়েক বছর আগেও সঠিকভাবে শৌচাগার ছিল না৷ ফলে সাংগঠনিক কাজে জেলাগুলিতে গেলে বেশ কয়েকয়বছর আগেও মাঠ বা নদীর পারেই যেতে হতো। এখন অবশ্য অবস্থা পাল্টেছে৷ কিন্তু কুম্ভযাত্রার দৌলতে আবার সেই অভিজ্ঞতা ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ এল। প্রাথমিকভাবে যেতে চাইনি। কিন্তু যখন দেখলাম সফরসঙ্গীদের অনেকেই মাঠমুখী তখন রিস্ক নিয়েই নিলাম। কিন্তু সেটাই কাল হলো। এমনভাবে পিছলে গেলাম যে গায়ে থাকা জামাকাপড় ফেলে দিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকল না। অগত্যা পরনের জামা, পাঞ্জাবি, অন্তর্বাস সব ফেলে অন্য পোশাক পরে গাড়িতে এসে বসলাম।
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ভোর ভোর পৌঁছালাম প্রয়াগরাজের কাছাকাছি। সঙ্গম ঘাটের দূরত্ব সেখান থেকে গুগুল ম্যাপ দেখাচ্ছে ৯ কিমি। কিন্তু দীর্ঘ যানজট। বার দুয়েক গুগুল ম্যাপের শর্ট-ডিসটেন্স নামক বুজরুকির সাহায্য নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বুঝতে পারলাম, গুগুল বাবাজির খেল খতম হয়ে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসমাগমে এসে রাস্তা হারিয়েছেন খোদ “গুগুল বাবা”। তাই তার উপর আর ভরসা না করাই ভাল। দূরে দেখতে পেলাম একটি পার্কিং। যেই পার্কিং-এ পুলিশ গাড়িগুলি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম আর এগোবো না। এখানেই পার্কিং করবো। কারণ, ততক্ষণে আমরা বুঝে গিয়েছি, যত ভেতরে প্রবেশ করবো তত তীব্র সমস্যায় আমরা পড়বো। তাই সেই পার্কিং-এ ঢুকে যাওয়া হলো। পরবর্তীতে জানলাম এই পার্কিং-টির নাম “কানহা পার্কিং”। যেটি প্রয়াগরাজ শহর সংলগ্ন ” ফুলপুর”-এ। এই ধরনের অসংখ্য পার্কিং প্রয়াগরাজ এবং তার সংলগ্ন এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে। এই সমস্ত পার্কিংগুলি মূলত কৃষি জমি। গম এবং ভুট্টার পাশাপাশি সর্ষে চাষ হয়। কিন্তু এ’বছর চাষ হয়নি। উত্তরপ্রদেশ সরকার আগাম ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, যাতে এবার চাষ করা না হয়।
মহাকুম্ভের মহাভিড়ে নিরিবিলিতে সঙ্গমে শান্তিতে ডুব
পার্কিং-এ ঢুকে সকলের শরীরের এমন হাল যে আর গাড়ি থেকে নামাই হলো না। গাড়ি পার্ক করে বেশ কয়েক ঘন্টা গাড়িতে বসেই ঘুমিয়ে নিলাম আমরা সকলে। ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল সাড়ে সাতটা৷ চোখ পড়লো পার্কিং-এর ভেতরেই অসংখ্য শৌচাগার এবং স্নানাগার। একে একে সকলেই সেখানে ভীড় করছে। আমরাও সকলেই গেলাম। শৌচালয়ের হাল কেমন হতে পারে তার আগাম অনুমান ছিলই। আর হলও তাই। যদিও সাফাইকর্মীদের সামান্য অর্থ দিয়ে সেগুলি পরিস্কার করিয়ে নেওয়া গেল। জলের ব্যবস্থা মোটের উপর ঠিকঠাকই ছিল।
শৌচকর্ম শেষে চা পান করার উদ্দেশ্যে পার্কিং-এর ভেতরেই থাকা একটি ধাবায় এলাম। নাম “সঙ্গম ধাবা”। সেখানে চা পান করতে করতেই পরিচয় হলো ধাবা মালিক প্রায় আমাদেরই বয়সী রাহুল বিশ্বকর্মার সাথে। তার কাছে জানতে পারলাম তাদের বাইক সার্ভিস রয়েছে। একটি বাইকে দুজন করে যেতে পারবে। খরচ হবে ৫০০ টাকা। ফিরতেও একই খরচ। অর্থাৎ যাওয়া আসা মিলিয়ে একজনের খরচ ৫০০ টাকা। সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বাইকেই যাবো। এরপর যতটা হাঁটতে হবে দেখা যাবে। সেই মতো রাহুল ভাইকে বাইকের ব্যবস্থা করতে বলে দেওয়া হলো। একইসাথে জানা গেল ওই ধাবাতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম আর কোথাও যাচ্ছি না। স্নান সেরে মেলা দেখে সোজা ধাবাতেই ফিরবো। হয়তো বা প্যাণ্ডেলের ক্যাম্পে শক্ত খাটিয়ায় রাত কাটাতে হবে। কিন্তু এরচেয়ে শান্তি আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তাই আমাদের দায়িত্ব রাহুল ভাই-এর কাঁধে ফেলে দেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
গঙ্গাস্নানে যাবো। তাই উপবাস থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্নান এবং পূজার উপকরণ আমরা জলপাইগুড়ি থেকেই নিয়ে গিয়েছিলাম। ফলে কেনাকাটার ব্যাপার ছিল না। সেগুলিকে সাথে নিয়ে রাহুল ভাই-এর ব্যবস্থা করা বাইকে আমরা রওনা হলাম গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে। প্রধান সড়কের ভীড় এড়িয়ে যেতে রাহুল ভাই এবং তার সাথীরা শর্টকাট রুট ব্যবহার করল। গঙ্গা নদীর পাশে চড় বালি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকলাম আমরা। হঠাৎ বিপত্তি! চলন্ত বাইক থেকে ছিঁটকে পড়লেন আমাদের সফরসঙ্গী শুভঙ্কর। বালির স্তুপের কারণে বড় কোনো ক্ষতি হল না। এবার সকলকে সাবধানে বাইক চালাতে পরামর্শ দেওয়া হল। অবশেষে ফের বেশকিছুটা রাস্তা অতিক্রম করে রাহুল এবং তার সাথীরা আমাদের পৌঁছে দিল নাগেশ্বর ঘাটে। এই পর্যন্তই বাইকে যাওয়া সম্ভব৷ এরপর থেকে হন্টন ছাড়া উপায় নেই। সেইমতো শুরু হলো হাঁটা৷
পূজার সামগ্রী যেহেতু আগে থেকেই সাথে রয়েছে, তাই প্রয়োজন শুধু ফুল এবং গঙ্গাজল নিয়ে আসার পাত্রের। ফুল খুব সামান্য টাকার কেনা হল। কিন্তু জলের ড্রাম কিনতে গিয়ে হাতে রীতিমতো ছ্যাঁকা লাগলো। ১০ টাকার ড্রাম কিনলাম ১০০ টাকা করে। তবুও সেটা সর্বনিম্ন। দাম চড়েছিল ১৫০ পর্যন্ত। অবশেষে রওনা হলাম গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে৷ সকলেরই গন্তব্য সঙ্গম ঘাটের দিকে। অর্থাৎ তিন নম্বর সেক্টর। যেতে হবে ১৯ নং পিপপুলের উপর দিয়ে। সেখানেই রয়েছে “লেটে হুয়ে হনুমানজী মন্দির”, নাগা সাধু, সঙ্গম দ্বার, নন্দী দ্বার আরও কত কি! স্বাভাবিকভাবেই সবার আকর্ষণ যেই দিকে সর্বোচ্চ ভীড়ও সেই দিকে। বাইক থেকে নামিয়েই রাহুল ভাই বলেছিল সঙ্গমে প্রচুর ভীড়। নদীর সঙ্গম হয়ে যাওয়ার পরে যেকোনো স্থানেই স্নান করা যায়। ফাঁকায় স্নান করতে হলে ২৬ অথবা ২৭ নং পিপপুল পেড়িয়ে গেলে ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাবে। সেইমতো আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম ওইখানে যাওয়ার৷ মাঝরাস্তায় পুলিশ বাহিনীকে জানতে চাইলে তাদের কাছ থেকেও একইরকম পরামর্শ পেলাম। বুঝলাম রাহুল ভাই ভুল বলেনি। সেইমতো ২৭ নং পিপপুল পেড়িয়ে আমরা গেলাম গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর মিলিত প্রবাহের ডানতীরে। সেখানেও ভীড় কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু কিছুটা উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি সম্পূর্ণ ফাঁকা ও নিরিবিলি জায়গা পাওয়া গেল।
পূজা মানেই মনের শান্তি। প্রচণ্ড ভিড়ে উপাসনা করে মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। তাই প্রথম থেকেই ভগবানের কাছে চাইছিলাম একটি ফাঁকা জায়গা। যেখানে মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আমার পূজা নিবেদন করতে পারি। আর হলোও ঠিক তাই। প্রথমেই গঙ্গার পারে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে রইলাম বেশকিছুক্ষণ। চেষ্টা করলাম শত উন্মাদনা থেকে মনকে শান্ত করার। আমি কে! কি কাজে এসেছি! কি আমার প্রার্থনা! তার সবটাই আরও একবার রোমন্থন করছিলাম। এরপর প্রস্তুত হলাম পূজার উদ্দেশ্যে৷ বস্ত্র বদল করে ধুতি চাদর পরে গঙ্গাবক্ষে পদার্পনের পূর্বে নদী তটে প্রণাম করে ক্ষমা ভিক্ষা করলাম মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে। কারণ, যে নদী ধরিত্রীর বুক সুজলা সুফলা করেছে, উর্বরতা দিয়েছে, তেষ্টা মিটিয়েছে, পবিত্রতা দিয়েছে, সেই মোক্ষ প্রদায়িনী মা গঙ্গার জলে নিজের চরণ স্পর্শ করানোর পূর্বে ক্ষমা প্রার্থনা আবশ্যক৷ এমনটা আমি মনে করেছি। জানিনা সকলের মত আমার সাথে মিলবে কিনা!

প্রণাম শেষে নামলাম মা গঙ্গায়। খুব বেশি জল নেই। যদিও আমি সাঁতার জানি না বলে বেশিদূরে যাওয়ার সাহসও দেখালাম না। ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি ডুব দিলাম। ডুব দিতে খুব বেশি পারদর্শী না হওয়ায় বা জল কম থাকার কারণে, কারণ যাইহোক নিজের সমগ্র শরীরকে ভেজাতে আমাকে যথেষ্টই বেগ পেতে হলো। অবশেষে স্নান সেরে সিক্তবস্ত্রেই নিজের অঞ্জলি ভরে জল অর্পন করলাম সূর্য নারায়ণ, মাতা গঙ্গা সহ স্বর্গ মর্ত্য পাতালের সকল দেবদেবীগণের উদ্দেশ্যে। মনের যাবতীয় আশা, আকাঙ্খা, দুঃখ, সুখ, বেদনা ঝরিয়ে দিলাম সেই অঞ্জলিভর্তি জলের সাথেই। এরপর বিধিমতো গঙ্গাপূজাও সারলাম। ঈশ্বরের অসীম কৃপা, যে এত প্রবল ভীড়ের মধ্যেও ওইটুকু সময়ের জন্য আমাকে যথেষ্ট ফাঁকা পরিসর প্রদানের জন্য, যাতে আমি পূর্ণ মানসিক তৃপ্তির সাথে আমার পূজা সম্পাদন করতে পারি। তিল, হরতকি, আমান্ন, দূর্বা, ফুল, ঘৃত, মধু,বস্ত্রখণ্ড, ফল, প্রদীপ এবং ধূপ নিবেদন করলাম মাতা গঙ্গার উদ্দেশ্যে৷ প্রার্থনা করলাম তোমার প্রবাহের মতোই নির্মল করো আমার হৃদয়। পাকের স্পর্শ পেলেও হৃদয়ে যেন সেই পাক স্থান না নিতে পারে।, সেই প্রবাহশক্তি দাও হে প্রাণপ্রবাহিনী। এরপর নদী হতে গঙ্গাজল এবং গঙ্গামাটি আহরণ করে আরও একবার প্রণাম জানিয়ে উঠে এলাম নদী থেকে৷
একে একে ঠিক একইরকমভাবে আমার সফরসঙ্গীরাও মা গঙ্গায় পুণ্যস্নান সেরে পূজা সারলেন এবং জল ও মাটি আহরণ করলেন। সবশেষে পোশাক বদলে বেশকিছুটা সময় নদীর পাশে বসে থাকলাম আমরা। কিছুক্ষণ বাদে সামান্য মেলা ঘুরে ২৮ নং পিপপুল দিয়ে ফিরে এলাম নদীর অপর প্রান্তে৷ যেখানে রাহুল ভাইরা আমাদের ছেড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ক্লান্তির কারণে সেদিন মেলা ঘুরতে আর মন সায় দেয়নি। আমরা স্নান ও পূজা সেরেছি মাঘী পূর্ণিমার আগের দিন। তাই পরদিনও শাহী স্নানে অংশ নেব এই বাসনাতেই আমরা প্রথম দিন স্নান সেরে ধাবায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেই।
রাহুল ভাই এবং তার সাথীরা বাইকেই আমাদের ধাবায় ফিরিয়ে আনে। ধাবায় ফিরেও সেই মনটা পড়ে থাকে নদীর ঘাটেই। কি দেখলাম! কি অনুভব করলাম! তার ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো শব্দ আমাদের কারও কাছেই নেই। শুধুমাত্র কি পাপস্খলন! পাপমুক্তি! মোক্ষলাভ! নাকি অন্যকিছু! আমার বিশ্বাস গঙ্গাস্নান করলেই যে পাপমুক্ত হওয়া যায় না, তা এখানে আগত সকলেই জানেন। ইহজন্মের পাপের ভোগ ইহজন্মেই করতে হয়৷ কর্মফল ভোগ কিরতেই হবে। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারীর অভিশাপকে ব্যর্থ করতে পারেননি। মানুষ তো কোন ছাড়! তাই পাপের বোঝা কমাতে এত মানুষ তীর্থরাজ প্রয়াগে কুম্ভস্নানে এসেছেন তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি এটাও বিশ্বাস করি না যে, তারা সকলে হুজুগের টানে এসেছেন। আমার বিশ্বাস তাদের আগমনের হেতু আরও গভীর। এই নদীর ঘাটে, এই মেলায়, এই জনসমাগমে আলাদা জাদু আছে। আছে ভক্তি। আছে দর্শন। আছে আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ। আছে অন্তরের পাপবোধ থেকে মুক্তির তৃপ্তি। আছে মানসিক শান্তি। আছে মৌনতার প্রাপ্তি৷ যা একজন মানুষকে রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম। হ্যাঁ, সত্যিই সক্ষম। যারা সত্যিই চান নিজের অন্তর-আত্মাকে দর্শন করতে, তিনি অবশ্যই নদীর ঘাটে বসে জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করবেনই। অবশ্যই করবেন। জীবনের ‘অমৃত পান’ তো বোধহয় একেই বলে। বাস্তবের অমৃত যেমন খাদ্যসুখ মেটায়। জীবনের অমৃত তেমনই জীবনের সারমর্ম বুঝতে সাহায্য করে। যেই সারমর্ম জীবনের অমৃতকে মন্থন করে তোলে অবশ্যই।
মহাকুম্ভে মিত্র লাভ! মানুষের মাঝেই তো অমৃত
২০২৫ সালের মহাকুম্ভের ১১ই ফেব্রুয়ারী ভোর থেকে ১৩ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিনদিন কুম্ভনগরী তীর্থরাজ প্রয়াগরাজে কাটানোর সৌভাগ্য আমার এবং আমার সাথীদের হয়েছে। এই সময়কাল আমার জীবনে কাটানো সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় মেলা গঙ্গাসাগর মেলায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে। কিন্তু কুম্ভের সাথে তার তুলনা কোনওভাবেই হয় না। যিনি কুম্ভের সময়কালে প্রয়াগরাজ যাননি, তিনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে বাস্তবের কুম্ভনগরীর রূপ কেমন। যেভাবে দূরে বসে মহাকাশকে জানা প্রায় অসম্ভব। তারজন্য মহাকাশে মানুষ বা মহাকাশ যান পাঠাতে হয়। ঠিক তেমনই কুম্ভকে জানতে হলে প্রয়াগরাজ যেতে হবে। অন্যথায় তার স্বরূপ উপলব্ধি করা এক কথায় অসম্ভব।
প্রয়াগরাজে পৌঁছে সকাল থেকে দুপুরের স্নান পর্যন্ত অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা আমি আগের অধ্যায়েই করেছি। এবারে আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরবো আমার অন্যান্য অভিজ্ঞতার কথা, যা আমি পরবর্তী সময়কালে সঞ্চয় করলাম। যেই অভিজ্ঞতা জীবনের চালায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাকে স্মরণ করাবে। ১১ই ফেব্রুয়ারি দুপুরের স্নান সেরে ২৮ নং পিপপুল পেড়িয়ে চলে এলাম নাগেশ্বর ঘাটের কাছাকাছি। সেখান থেকে আমাদের বাইক সাথীরা আমাদের সাথে করে নিয়ে চলে এলো সঙ্গম ধাবায়। ততক্ষণে ধাবার পাশের পার্কিং লট ভরতে শুরু করেছে। হাজারে হাজারে গাড়ি, লক্ষ লক্ষ মানুষ তিল ধারনের জায়গা নেই। সকাল থেকে পেট ফাঁকা। পূজোর কারণে উপবাস থাকায় স্নানে যাবার সময় কিছুই খাওয়া হয়নি। পেটে তখন ছুঁচো ডন মারছে। এদিকে মেলা চত্বরে সেভাবে ভালো কোনো খাবারের দোকান চোখে পড়েনি। বেশকিছু ভাল ফুডস্টল সেক্টর ৩ এ থাকলেও ভীড়ের কারণে সেখানে যাওয়া হয়নি। ভাণ্ডারা চলছিল প্রচুর। সেখানেও ভীড় এতই বেশি যে ক্লান্ত শরীরে সেখানে দাঁড়ানোর মতো ইচ্ছে আমাদের কারোই ছিল না। উপায় ছিল একটাই ধাবায় ফিরে আসা। সেইমতো ধাবায় ফিরে এসে রাহুল ভাইকে বললাম সকলের খাবারের ব্যবস্থা করতে। ততক্ষণে রাহুল ভাই-এর দোকানের খাবার শেষের পথে। ফের রান্না চড়ানো হয়েছে। সেটিও যাবতীয় চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। মুহূর্তেই যে শেষ হয়ে যাবে তা বলাই যায়। এমতাবস্থায় আমাদের জন্য ডাল-চাওলের ব্যবস্থা হলো।
ডাল-চাওল মানে বাঙালি ডাল-ভাত আর তারসাথে ফুলকপির তরকারি। এই খাবারই যেন অমৃত। সকলে তাই গোগ্রাসে গিললাম। সন্ধ্যা তখন প্রায় ৭ টা। এটাই প্রায় দুপুর এবং রাতের খাবার। এরপর বেশকিছুক্ষণ বিশ্রাম। তবে নামে বিশ্রাম হলেও কাজে বিশ্রাম হলো না। আমার জিজ্ঞাসা পিপাসু মন ততক্ষণে রাহুল ভাই-এর সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করে নিয়েছে। সাথে আরও স্থানীয় কয়েকজন। তাদের সাথে শুরু হল গল্প। জানতে লাগলাম অনেক সত্য। যেই জমিতে আমরা আছি সেগুলি মূলত উচ্চফলনশীল গম ও ভুট্টা এবং সর্ষে চাষ হয়। কিন্তু এবার চাষ হয়নি। ক্ষতিপূরণ আগাম দেওয়া হয়েছে। গোটা মেলায় আমিষ বন্ধ। কেউ আমিষ রান্না করলে পুলিশ এসে তা ফেলে দিচ্ছে। এমন ঘটনা এই ধাবাতেও হয়েছে বলে জানা গেল। আরও জানা গেল মৌনী অমাবস্যার দিন যে “ভাগদর” (পদপৃষ্ঠ) এর ঘটনা ঘটেছিল তাতে এমন অনেক তথ্য যা এই লেখায় প্রকাশ করে আমার বন্ধুদের বিপদে আমি ফেলতে পারবো না। প্রতিটি তথ্যের সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণও তাদের কাছে রয়েছে এমনটাও জানা গেল। মেলা নিয়ে আতঙ্ক যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তাই তা গোপন রাখাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন সবাই। আমিও সেই একই মত পোষণ করি।
এমনই অনেক কত কত গল্পমালা এক এক করে শুনতে শুনতে রাত গভীর হল। রাহুলভাইয়া আবার খাওয়ার ব্যবস্থা করলো। আমরা তিনজন খেলাম। বাকিরা আর খেলো না। এরপর ঘুমানোর পালা। দুজন গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বাকি তিনজনের থাকার ব্যবস্থা করলেন রাহুল ভাই। খাটিয়ায় গরম কাপড় বিছিয়ে দিলেন। আমাদের সাথে পাতলা কম্বল রয়েছে দেখে একটি মোটা কম্বলের ব্যবস্থা করলেন তিনি নিজেই। এরপর নিজেও ঘুমিয়ে গেলেন আমাদের সাথেই। দুজন দুজনকে কথা দিলাম সকাল সকাল যে উঠবে, সেই অপরজনকে ডাকবে। কারণ কাল সকালে যে মাঘীপূর্ণিমার তিথি। শাহী স্নান। আরও একবার স্নানের ঘাটে যেতে হবে যে। প্রতিশ্রুতি তো দেওয়া হলো, কিন্তু দু’রাতের প্রচণ্ড ক্লান্তি কখন যে চোখের পাতায় ভর করে নেমে এলো বুঝতেই পারলাম না। মোবাইলের এলার্ম কখন বাজলো তা জানতে পারলো না কেউই। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে রাহুল ভাই-এরও আর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হলো না। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘড়িতে ৯ টা বাজে। রাহুল ভাই-ও তখনও শুয়ে। আমার সাথীরাও কেউ বিছানা ছাড়েনি।
প্রথমেই রাহুল ভাইকে ডাকলাম। এরপর একে একে সকলে উঠলেন। বরাবরই বাসি মুখে চা খাওয়ার বাজে অভ্যাস আমার রয়েছে। আমার সাথে নিত্যদিন যারা থাকেন,তারা সেটা জানেন। রাহুল ভাই-এর এই তথ্য জানার কথা কখনই নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য! তিনি সরাসরি আমার জন্য চা নিয়ে হাজির। পছন্দমতো আয়োজন পেয়ে ততক্ষণে আমি মুগ্ধ। এরপর দ্রুত শৌচকর্ম সেরে পোশাক বদলে তৈরি হয়ে গেলাম মাঘীপূর্ণিমার পুণ্যস্নানের জন্য। এদিন অবশ্য বাইক সার্ভিস কম থাকায় এক এক করে স্নানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। প্রথমেই আমি এবং আমার সঙ্গী সপ্তর্ষি স্নানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর মাঝে অবশ্য রাহুল ভাই আমাকে তার বাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। রাহুল ভাইকে নিয়ে সেই গল্পে আমি পরের অধ্যায়ে আসবো।

রাহুল ভাই-এর বাড়ি থেকে ফিরে তার বাইকে আমি আর সপ্তর্ষি গেলাম গঙ্গাস্নানে। আগেই বলে রেখেছিলাম ভীড়ে যাবো না। ফাঁকা জায়গায় স্নান করবো। সঙ্গমঘাটে যেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। সেই মতো শর্ট রাস্তা ব্যবহার করে রাহুল ভাই আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলেন নির্মীয়মান একটি ব্রিজের ঠিক নিচে। জায়গাটিতে অসংখ্য চিতা একসাথে জ্বলছে। বুঝতে বাকি রইলো না কিছুই। এই চিতাগুলি অনেক প্রশ্ন এবং তার উত্তর হয়তো দিয়ে গেল। কিন্তু মনের প্রশ্ন আর না বাড়িয়ে রাহুল ভাইকে বলে ফেললাম এখানে স্নান সম্ভব নয়। নাগেশ্বর ঘাটেই চলো। এরপর ফের ফিরে গেলাম নাগেশ্বর ঘাটে। সেখানেই শাহী স্নানের মূহুর্ত উপভোগ করলাম। যদিও এখানে জলের হাল এতটাই খারাপ যে শাহী স্নানের সেই আমেজ কোনোমতেই পেলাম না। বরং একদিন আগে যে স্নান করেছিলাম তাই মনে দাগ কেটে থাকলো। আমি এবং সপ্তর্ষি ছাড়াও রাহুল ভাই নিজেও স্নান করলেন। ফিরে এলাম ঘাট থেকে। কিন্তু মনের প্রশ্নটা রয়েই গেল। তবে কি ওই চিতা গুলিই! তবে কি ওই পোড়া কাঠগুলিই! অনেক প্রশ্নের উত্তর অধরাই থেকে গেল। যার সবগুলির উত্তর হয়তো রাহুল ভাই-এর কাছেও নেই! হয়তো বা আছে! হয়তো উচ্চারণ করা যায় না! পাছে রাজরোষের শিকার হতে হয়! হয়তো বা এই প্রশ্নের উত্তর আর কখনও জানাও যাবে না! হয়তো বা তাই। এগুলি ভাবতে ভাবতেই ফিরে এলাম ধাবায়।
গোটা শরীরে ততক্ষণে একটা অস্বস্তি। কারণ দ্বিতীয় দিনের গঙ্গাস্নানের জলের হাল এতটাই খারাপ ছিল যে, দ্বিতীয়বার পরিস্কার জলে স্নান করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবুও কিছুটা সময় ঠায় বসে রইলাম। বাকিদের নিয়ে রাহুল ভাই এবং তার এক সাথী স্নানে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে ফিরেও এলেন। ততক্ষণে গঙ্গাস্নানের পর পরিস্কার জলে আরও একবার সাবান শ্যাম্পু সহযোগে স্নান করা আমার হয়ে গিয়েছে। এরপরেই ঘটলো সেই বিরল মূহুর্ত। যা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে’ এই প্রবাদ শুনেছি। ভগবান যে আমার জন্য তাই বাস্তব করে দেখাবেন তা আমি ভাবতেও পারিনি।
মিলনরানী সরকার নামে এক ভদ্রমহিলার অমৃত কুম্ভের সন্ধানে এসে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ পথ ঘুরতে ঘুরতে আমার শরণে আসা এবং পরিবারের সাথে পুনর্মিলন হওয়ার সেই কাহিনি আমি পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব। তবে শুধু এই টুকুই বলার, এই ঘটনা আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে হয়তো পুণ্যস্নান হেতু নয়, ওই মহিলাকে আমার মাধ্যমে উদ্ধার করানোর জন্যেই ঈশ্বর আমাকে কুম্ভ নগরী প্রয়াগরাজে ডেকে এনেছেন। মিলনরানী দেবীকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়ে তৃপ্ত আমি এবং আমার টিম ওই রাত্রিও সঙ্গম ধাবাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ। একটি হল আমাদের পরের গন্তব্য অযোধ্যার পথে প্রবল জ্যাম। ফলে সেখানে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, রাস্তায় জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার থেকে রাহুল ভাই-এর আতিথ্য গ্রহণ করা অনেক ভাল। এই দুই কারণেই সেই রাতেও সঙ্গম ধাবায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা।
সাধু দর্শন করতে গিয়ে অসাধুর খপ্পরে পড়া
সঙ্গীদের মন এবং জীভের স্বাদ ধরে রাখতে আমাকে এবং রাহুল ভাই ও তার সঙ্গীদের বহু কিমি দূরে গিয়েও ভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। এমনকি বহুদূরে রান্না করিয়ে নিয়েও আসতে হয়। সেই খাবারেই তৃপ্ত হই আমরা সকলে। আমরা বাঙালি। দীর্ঘমেয়াদি নিরামিষ আমাদের রোচে না। রোচার কথাও নয়। খাদ্যাভাস যে কোনও মানুষের একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়। কোনও সরকার জোর করে কারও জিভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। তাই এই নিয়ম ভেঙ্গে আমরা কোনোরূপ অন্যায় করিনি বলেই আমার বিশ্বাস।সেই রাত্রের খাওয়া দাওয়া শেষে আবার আরও একটি নিশ্চিত নিদ্রায় রাতটা পার করি সবাই। ক্লান্তি আগের দিনের তুলনায় কম থাকায় সকাল সকালই ঘুম ভাঙে। এদিন আর গঙ্গাস্নানের দিকে পা বাড়াইনি আমরা। সোজা স্থানীয় স্নানাগারে স্নান সেরে বেড়িয়ে যাই সঙ্গম ঘাটের উদ্দেশ্যে। যেহেতু অযোধ্যা যাওয়া একপ্রকার বাতিল হয়ে গিয়েছে, তাই সিদ্ধান্ত নেই আজ গোটা মেলা ঘুরে দেখবো। সেইমতো নিজেদের গাড়ি নিয়েই ‘কানহা পার্কিং’ ছেড়ে মেলার ভেতরে চলে যাই। রাহুল ভাইকে বলে যাই ফেরার সময় তোমার সাথে সাক্ষাৎ করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হব। সেইমতো মেলার ভেতরে নাগেশ্বর ঘাট পার্কিং-এ আমাদের গাড়ি রাখা হলো। কিছুদূর হেঁটে নাগেশ্বর ঘাটে পৌঁছালাম। সেখান থেকে একটি অটো করে পৌঁছে গেলাম ১৯ নং পিপপুল। সেই পিপপুল পেরিয়ে পৌঁছালাম তিন নম্বর সেক্টরে।

শাহিস্নানের দিন পেরিয়ে গিয়েছে একদিন আগেই। কিন্তু তারপরেও সেখানে যে বিপুল ভীড় তা কল্পনাও করা যাবে না। এর ঠিক আগ মুহূর্তে আমার সাথী সন্টু দা নাগা সাধু দর্শনে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাকে নাগা সাধু দর্শন করাতে গিয়ে এক নাগার খপ্পরে পরে বেশকিছুটা টাকা দণ্ডি গেল আমার। কোন মোহজালে পড়ে আমি যে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হলাম তা এখনও আমি বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের স্বভাবোচিত ভঙ্গিতে সেই নাগা সাধু আমাকে ডাকলেন। গেলামও তার কাছে। তার ভাষার কিছুই প্রায় আমি বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বেশকিছুক্ষণ ঝাড়ফুক দিলেন। এমন সময় আমি দক্ষিণা দিতে গেলাম। সাধু আমার কাছে ভোজনের অর্থ চাইলেন। আমারও মন চাইলো দেই কিছু অর্থ। এরপর যেই না ব্যাগ বের করলাম “লকসমী দিখাও” বলে ব্যাগে থাকা যাবতীয় টাকা বের করে নিলেন তিনি।
ক্যাশ টাকা বেশি ক্যারি করার অভ্যাস আমার নেই। ফলে ১০০০-১২০০ টাকার মতো ছিল আমার ব্যাগে। সেই টাকাটাই পুরোপুরি বের করে নিলেন। সেই টাকাকে দুটো ভাগে ভাগ করলেন। একটি ভাগ আমাকে দিলেন যাতে তিনটি ১০০ টাকার নোট। সাথে দিলেন একটি রুদ্রাক্ষ। এরপর আমাকে তার লিঙ্গ দর্শন করালেন। আমি দূর থেকে প্রণামও করলাম। ইতিমধ্যেই বাকি যাবতীয় টাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের সেই হাত রগড়ালেন। আর এরমধ্যেই টাকা ভ্যানিশ হয়ে হাতে জল চলে এলো। এরপর সেই সাধু আমাকে বলতে লাগলেন “নাগা সাধু কা পাওয়ার দেখা”। আমি বুঝলাম আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। যা গেছে যাক! এবার আমার বেড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। দ্রুত ডেরা থেকে বেড়িয়ে এলাম। মনটা দিনের মতো ভার হয়ে গেল। আমি একজন সনাতনী। সনাতন সংস্কৃতি এবং আমার ধর্মের প্রতি আমার আস্থা প্রচুর। কিন্তু কেউ আমার ধর্মের আশ্রয় নিয়ে নির্লজ্জ ব্যবসা করবে তা আমি কখনই মন থেকে মেনে নিতে পারি না। বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি যে এই ব্যাক্তি প্রকৃত নাগা সন্ন্যাসী নন। হিন্দু ধর্মের রক্ষক প্রকৃত নাগা সন্ন্যাসীরা এই ধরণের অপকর্ম করেন না। অর্থ আমার গেলেও যতটা না অর্থের জন্য আমি দুঃখ পেয়েছি, তার চেয়েও অনেক বেশি দুঃখ পেয়েছি সনাতন ধর্মের এই অপব্যবহার দেখে।
তিন দিনের সফর, সারা জীবনের সঞ্চয়
সাধুর পর্ব মেটার পর আর কোনও সাধু সন্তের ডেরায় যাওয়ার সাহস আমি পাইনি। সোজা চলে গেলাম “লেটে হুয়ে হনুমানজি মন্দিরে”। যদিও সেখানে এতটাই প্রবল ভীড় যে, বাইরে থেকে হনুমানজিকে দর্শন করে প্রণাম করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর বাড়ির ছোটোদের জন্য কিছু কেনাকাটা শেষে চলে গেলাম খাবার স্টলে। ডাল চাওল খাওয়ার ইচ্ছে আর কারও হলো না। লস্যিতেই সারলাম মধ্যাহ্ন ভোজ। গ্রহণ করলাম আদানি গ্রুপের দেওয়া বিনামূল্যে “আরতি সমগ্র”। যদিও তা হিন্দিতে লেখা। আমার আপাতত কোনও কাজে আসবে না। কারণ আমি হিন্দিভাষা পড়তে অক্ষম। এরপর রওনা হলাম সেই সঙ্গম তটের উদ্দেশ্যে। যত এগোচ্ছি ততই পিলপিল করে বাড়ছে ভিড়। একটা সময় ভিড়ের ঠেলায় রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। তা অতিক্রম করে পৌঁছালাম সঙ্গম তটে।
কী অপূর্ব দৃশ্য! একদিকে মা গঙ্গা, অন্যদিকে মা যমুনা। অন্তঃসলিলা সরস্বতীকে দেখা না গেলেও হৃদয় যেন দুই নদীর মাঝে তাকে দেখতে সক্ষম। মা গঙ্গার সাদা জলরাশি, মা যমুনার কালো জলধারা ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে প্রয়াগের জলে। তৈরি করছে এক বৃহৎ প্রবাহের। যেই প্রবাহ যুগ যুগ ধরে কালের শুরু থেকে আজ অবধি ধারণ করেছে এই ভারত ভূমিকে। যার ছোঁয়ায় উর্বর হয়েছে ধরিত্রী। ফসল দিয়েছে ভূমি। পানীয় পেয়েছে বসতি। আরও কত কি! গ্রাম্য সভ্যতা থেকে নগর সভ্যতার বিকাশ, সভ্যতার সূচনা থেকে সভ্যতার ধ্বংস সকল ভাঙাগড়ার সাক্ষী এই সম্মিলিত বারিধারা। এই নদী দেখেছে রামায়ণ-মহাভারত! এই নদীর তটেই হেঁটে গিয়েছেন আদি গুরু শঙ্করাচার্য সহ কত সিদ্ধ পুরুষ! এই নদীর পাশেই বৈদিক সভ্যতা, ষোড়শ মহাজন পদ। এই নদীই মৌর্য, গুপ্ত আদি রাজত্বের সাক্ষী। এই নদী তটেই সুলতান, মোঘল, পাঠানের কত আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমন। এই নদী তটেই ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন। এই নদীকে কেন্দ্র করেই ভারতের বেঁচে থাকা। পরাধীন থেকে স্বাধীন ভারতের নির্মানের সাক্ষী এই নদী। সব কিছুই যেন একেবারে একইসাথে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। প্রবল ভীড়ের কারণে সঙ্গম তটে স্নানের সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে বিরত করলাম আমি। আমাদের বাকি সাথীদের দুজন যদিও স্নান করেছেন। বাকিরা অবশ্য আমার পথই অনুসরণ করেছেন।
স্নান শেষ, প্রায় শেষ তিনদিনের প্রয়াগ সফর৷ এবার ঘরে ফেরার পালা। এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকলাম কত কথা! কী দেখলাম! কী অনুভব করলাম! এ জন্মে কি আবার এই মহামিলনের উৎসব দেখার সুযোগ আদৌও হবে! জানি না! এইসব ভাবতে ভাবতেই ফের উঠে বসলাম অটোতে। পৌঁছে গেলাম আমাদের গাড়ির কাছে। গাড়ি ছাড়লো। বাকিদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার জোড়াজুড়ির কারণে ফের ফিরলাম সঙ্গম ধাবায়। কারণ রাহুল ভাই এর সাথে সাক্ষাৎ করতেই হবে। সে যে আমার বন্ধু। বন্ধুকে একবার শেষ বিদায় না জানিয়ে কিভাবে ছাড়তে পারি তীর্থরাজ প্রয়াগ! না হলে তো আমার প্রয়াগ যাত্রা সফলই হবে না। সেইমতো ফিরলাম ধাবায়। সাক্ষাৎ হলো, গল্প হলো, চা-পান হলো। আরও কিছুটা সময় থেকে যেতেও মন চাইলো। বাঁধ সাধলো পুলিশের হুকুম। পার্কিং এ গাড়ি নেই, তাই রাস্তায় দাঁড় করানো গাড়ি এক্ষুণি সরিয়ে নিতে হবে। অগত্যা রওনা হলাম। সন্ধ্যার তারা ভরা জ্যোৎস্নামণ্ডিত পূর্ণিমার আকাশে তখন পূর্ণ চাঁদ। তার আলোয় ঝলমল করছে “তারো কা শহর প্রয়াগরাজ”। এদিকে আমার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করল। আলোর ঝলকানি ঝাপসা হয়ে উঠল আমার অশ্রুসজল দু চোখে। মন ভারাক্রান্ত। চোখে তার প্রকাশ। হৃদয়েও কান্না আসছে। তিনদিনে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি শহরটিকে। যাকে চাইলেও হয়তো ভোলা সম্ভব নয়।