ট্যুরে বেরিয়ে আমরা যদি চাই একটু প্রশান্তি, পাঁচ তারায় নয়, তা মিলতে পারে মাটির মায়া জড়ানো কোনও সহজ-সরল পরিবেশেই। লিখলেন রাইমা বসু-
বিষ্ণুপুর এক প্রাচীন বর্ধিষ্ণু শহর যেখানে পোড়ামাটি গল্প বলে। প্রাচীন মন্দিরের গায়ে ইতিহাস-পুরান-কৃষ্ণলীলার কানাকানি। সেই কাহিনীই আবার ধরা পড়ে বালুচরীর বুননে। বিষ্ণুপুরী ঘরানার ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই মন টানে এখানের প্রকৃতি। আলাপ, বিস্তার, সবেতেই সবুজ আর মেঠো গন্ধ। সাথে আছে লালগড় বাঁধ। অনেকে লালগড় জঙ্গলের ভেতর পুরোনো এরোড্রমও দেখতে যান।
আমার বিষ্ণুপুর ঘুরতে যাওয়াটা হঠাৎ ই ঠিক হয়েছিল। কোনও প্রপার প্ল্যানিং পর্যন্ত ছিলনা। একজন সব ঠিক করে দিলেন আর আমরা পৌঁছে গেলাম। জীবনে প্রথমবার কোনও হোমস্টে তে থাকা। এর আগে কোথাও বেড়াতে গেলে হোটেলেই থেকেছি। আর সত্যি বলতে কি সেটা সিলেক্ট করতে গিয়ে কতটা লাক্সারি জুটবে, কটা স্টার সেই হোটেলের এগুলোই দেখা হতো। স্টেশনেই অপেক্ষা করছিল টোটো। আমার কর্তার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন কোনও ডাক্তার বাবু। যিনি গাইড করছিলেন সবকিছু। যেন তাঁর বাড়িতে অতিথি আসছে। পৌঁছনো মাত্র একজন রোগাসোগা মানুষ এক গাল হাসি নিয়ে হাজির। সাথে তাঁর স্ত্রী। সেই প্রথম দেখা দিলীপদা আর ববিতাদি কে।
খানিক পরেই হাজির লাঞ্চ। ডাক্তারবাবু বারবার ফোনে বলেছিলেন এখানের খাবার কাঠের জ্বালে রান্না হয়। একটু স্মোকি লাগবে খেতে। আমাদের ভালো লাগবে কিনা। সত্যি বলতে এমন মোটা চালের ভাত এর আগে কোনও দিন খাইনি। কিন্তু কি সুন্দর লাগছিল সেটাও। রান্না যা কিছু– তার সবটুকুর মধ্যে মিশে ছিল দিলীপদা আর ববিতাদির সারল্য। পরিমাণ নিয়ে নাই বা বললাম। যত বলি এত জীবনে খাইনা, ওনারা বলেন এর থেকে কম দেওয়াই যায় না। আর পরিবেশনের সময় ওই যে সারল্য আর জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে দিলীপ দা দাঁড়াতেন ফিডব্যাক এর জন্য… তার পর আর রান্নার কোনও ত্রুটি খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব? এই আন্তরিকতা, এই আপ্যায়নেই তৃপ্তি জুটত মন ভরে।
‘মৃত্তিকা’তে সত্যিই মাটির স্পর্শ আর গন্ধ আছে। ছিমছাম সুন্দর বাড়িটায় দোতলার প্রথম গেস্ট আমরা। বিরাট ঘর, প্রয়োজনের সব কিছু সেখানে মজুত। দেওয়ালে সুন্দর আলপনার ডিজাইন। পরে জেনেছি স্টেনসিলস এর ওই কাজগুলো ডাক্তারবাবুর প্রিন্সেসের করা। দোতলায় ওঠার জন্য একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। সেখানেই যত গণ্ডগোল। দিনের মধ্যে দশবার আমার লিফট এই ওঠানামা অভ্যেস। সাথে আবার ভার্টিগো । নিচে দেখলেই মাথা বনবন। বুড়ো বয়সে এসব লোককে বলি কি করে! এদিকে আমার কর্তাটির ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। চড়ছেন, নামছেন, বয়স ভুলে দোলনাতেও দুলছেন। আমি অবশ্য লোকজন থাকলে তবেই ওঠা নামা করছি। হড়কে গেলে কেউ যদি ক্যাচ লোফে সেই ভরসায়। ডাক্তারবাবু যদিও খুব ভরসা দিলেন যে এই সিঁড়ি থেকে কেউ হড়কায় না। কিন্তু… ওই আর কি।
ড.ধীরাজ বিশ্বাস– যাঁর কথা আলাদা করে না বললেই নয়। যাঁর আন্তরিকতাই সব থেকে বড় মূলধন মৃত্তিকার। যিনি মালিক তো বটেই, আমাদের বিষ্ণুপুর ভ্রমণের গাইড ও। যাঁর প্রতিদিনের সন্ধ্যের গল্প ভরিয়ে রাখতো আমাদের, চেনাতো শহরটাকে, শহরের সংস্কৃতি আর মানুষগুলোকে। ওনার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে ডাক্তারি ছাড়াও যে ফটোগ্রাফিও আছে সেটা জেনেছি পরে। মৃত্তিকাতে ঢোকা মাত্র রুমে বেড এর ওপর বিষ্ণুপুর সম্পর্কে একটা সুন্দর লেখা পাবেন। ওটাই সবার আগে মন কেড়েছিল।
লিখতে গেলে শেষ হবে না এ এক এমন অভিজ্ঞতা। ইঁদুর দৌড়ের মাঝে ফুরসৎ মিললে নিজেকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে হয়, জীবন থেকে আমরা ঠিক কি চাই। সত্যিই কি প্রতিটা ট্রিপ এর ৫ তারা লাক্সারি আমাদের সেই শান্তিটা দিতে পারে যা আমরা খুঁজে বেড়াই? জীবন খুব সহজ সরল গতিপথ চায়। তাকে অকারণ জটিল করি আমরাই বা আমাদের পরিস্থিতি। জীবন আসলে সারল্য খোঁজে। “ভালো- বাসা” খোঁজে। শুধু দেখার জন্য মনের জানলাটা খুলতে হয়। লালগড় এর একরাশ সবুজের মাঝে ‘মৃত্তিকা’ তাই বারবার মন টানবে।
Feature image and other photos were obtained by the author.
What a beautiful piece of writing !!
The writer has weaved a magic around ‘Mrittika’ with her words, enticing the readers to try out this place.
Thank you very much for your comment.
সত্যি সুন্দর আর মনের মত করে তৈরি করা মৃত্তিকা।।
ছোট থেকেই এই ডাক্তার মানে আমার বা বন্ধু মহলের ধীরু ভাই এর সৃজনশীলতা এক অন্য মাত্রা পেয়ে এসেছে। বরাবরের ট্যালেন্টেড ।।
আরো ভালো হোক । এটাই ছড়িয়ে পড়ুক
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভারি সুন্দর লেখা। মনে হল যেন এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। তথ্য ভারে আক্রান্ত নয়। ‘মৃত্তিকা’র মাটির স্পর্শ আর গন্ধ মেখে যেন ফুরফুরে একটা ছুটির দিন কাটানো। চলতি লেখাপত্তরের ধরণ ধারণের বাইরে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত জায়গাকে এভাবে আমাদের জানানোর জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আগামীদিনে ‘মৃত্তিকা’য় যাওয়ার ইচ্ছে রইল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মানসচক্ষে বেড়িয়ে এলাম।। লেখিকার বর্ণনার সাবলীলতায়, ওখানকার পরিবেশ আর পরিবারের সারল্য অনুভব করলাম। শুধু, খাবারের স্বাদ আর আন্তরিকতার ছোঁয়া সাক্ষাতে পেতে ( যা ভাগ করলে বেড়ে যায়!) বেড়াতে যাবার ইচ্ছা রইল, দিন গোণার শুরু….