ইনফোয়ানা ফিচার: হেন অপবাদ নেই, যা তাঁকে শুনতে হয় নি। স্বজাতির বাক্য বিষের দংশনে নীল হয়ে যাওয়া নীলকন্ঠ কবি তিনি। বঙ্গদেশে তাঁর সমালোচকেরা সংখ্যায় এবং শক্তিতে কম ভারী ছিলেন না। এ’কালের ভাষায় যা ট্রোল, সে’কালে তার সবথেকে সহজ শিকার ছিলেন জোড়াসাঁকোর রবিবাবু।
‘পায়রা কবি’ থেকে অন্যের ‘গল্পের প্লট চোর’- রবীন্দ্রনাথের নিন্দায় নেমে শব্দ প্রয়োগে কখনও সংযমের পরিচয় দেয় নি বাঙালি। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় গান ও কাব্যগুলিকে নিয়ে চটুল প্যারোডি নামানো ছিল তাঁর সমালোচকদের সবথেকে প্রিয় বিনোদন।
তবে ভক্তের স্তুতিতে যেমন তিনি কখনও উদ্বেলিত হতেন না তেমনি নিন্দকের শ্লেষও তাঁকে বিচলিত করত না। স্বদেশবাসীর অকারণ নিন্দা-সমালোচনা বিশ্বকবিকে কষ্ট দিয়েছে বটে কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতাকে নষ্ট করতে পারে নি। আসলে আলোর রবিকে যে কখনও কালো মেঘ গ্রাস করতে পারে না।
জমিদার পুত্র বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জীবদ্দশায় কম কটাক্ষ শুনতে হয় নি। অথচ অর্থাভাবে তাঁকে জীবনে বহুবার ঋণ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। শান্তিনিকেতন ছিল কবির কাছে তীর্থতুল্য। বিশ্বভারতী ছিল স্বপ্ন। বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে স্ত্রীর গয়না পর্যন্ত বেচতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয়ের খরচ চালাতে কার্যত ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরোতে হয়েছিল গুরুদেবকে। কখনও দেনা করে, কখনও হাত পেতে দান নিয়ে চালিয়েছেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান।
জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে মৈত্রেয়ী দেবীকে আক্ষেপ করে বাঙালির প্রাণের কবি বলছেন- “লোকে জানে উনি শৌখিন বড়লোক। সম্পূর্ণ নিঃসম্বল হয়েছিলুম, আমার সংসারে কিছুমাত্র বাবুয়ানা ছিল না। ছোটবউকেও অনেক ভার সইতে হয়েছে, জানি সে’কথা তিনি মনে করতেন না। কিন্তু এত বাধা যদি দেশের লোকের কাছ থেকে না পেতুম তাহলে শুধু অর্থাভাবে এত কষ্ট পেতে হত না।”
সংসারে থেকেও তিনি ছিলেন নিরাসক্ত উদাসীন। কবি বলেছেন, “আমি কখনও নিজেকে জড়িয়ে ফেলি নি সংসারে। কোনও কিছুতেই আবদ্ধ হয়ে পড়া আমার স্বভাব নয়।” কূপমন্ডূক তো নয়ই বরং কেউ তাঁকে ভবঘুরে বললে বেশ খুশিই হতেন। আসলে উপনিষদের বিশ্ববোধ ছিল বিশ্বকবির অন্তরের চালিকাশক্তি। তাই আমাদের প্রাণের কবি বিশ্বপথিকও।
সারা জীবনে মোট ১২ বার বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। পাঁচটি মহাদেশের তিরিশটিরও বেশি দেশ তাঁর ঘোরা। ১৭ বছর বয়সে প্রথম বিলেতে গমন। ১৯৩২ সালের এপ্রিলে যখন পারস্য ভ্রমণে গেলেন, তখন কবি একাত্তর ছুঁই ছুঁই। জীবনের শেষ কটা বছর অশক্ত দেহেও চারবার এসেছেন কালিম্পং পাহাড়ের মংপুতে। তাই তিনিই বলতে পারেন-
বিশাল বিশ্বে চারি দিক হতে
প্রতি কণা মোরে টানিছে।
আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ
শত কোটি কর হানিছে।
Video and Feature credit- Infoyana YouTube channel.