বিশেষ প্রতিবেদন: মুখপাত্র পদ আগেই গেছে। এবার রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের পদটিও গেল। কিন্তু তারপরেও তৃণমূলেই থাকবেন কুণাল ঘোষ। কুণালের কোনও আব্দারই মমতা রাখেন নি। যাঁর নাম শুনলেই কুণালের গাত্রদাহ হয়, সেই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যথারীতি উত্তর কলকাতা থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে সৌগত রায়কে রাজনীতি থেকে অবসরে পাঠানোর অনেক কোশিস করেছেন কুণাল, ৭৬ বছরের সেই প্রবীণ নেতাকেও ফের দমদম থেকে টিকিট দিয়েছে তৃণমূল। এক সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কুণালকে বেশ খাতির করতেন। অভিষেকের দৌলতেই নাকি তৃণমূলে কুণালের মুখপাত্র ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রাপ্তি। কিন্তু এখন অভিষেকও কুণালকে পাত্তা দেন না বলে খবর। দলে ব্রাত্য কুণাল ঘোষ মাঝেমধ্যেই বিদ্রোহ করতে চান কিন্তু মুশকিল হল বিদ্রোহ করার মতো মনের জোর বা মাজার জোর, কোনওটাই তাঁর নেই।
কুণাল ঘোষ নিঃসন্দেহে সুবক্তা। জোরের সঙ্গে নিজের বক্তব্য পেশ করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাঁর জুড়ি নেই। তৃণমূল ও রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে, এমন অনেক ইস্যুতে আত্মপক্ষ সমর্থনে মিডিয়ার সামনে কুণালকেই এগিয়ে দিয়েছে দল। কিন্তু কুণাল অর্জুন সিং নন। অর্জুন তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েই মনোনয়ন পান এবং জিতে সাংসদ হন। আবার হঠাৎ একদিন বিজেপি থেকে তৃণমূলে গিয়ে ভেড়েন। কিন্তু মমতা তাঁকে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করা মাত্রই তৃণমূল ছেড়ে দিতে পাঁচ মিনিট ভাবেন নি ব্যারাকপুরের সাংসদ। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া অর্জুন ফের বিজেপির উত্তরীয় গলায় পরেই নিজের মনোনয়ন কনফার্ম করে ফেলেন, এমনই তাঁর এলেম! পক্ষান্তরে ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে ও হতাশায় ক্ষিপ্ত হয়ে কুণাল ঘোষ মাঝেসাঝে বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেও পুনরায় মুষিকে পরিণত হতে দেরি করেন না।
উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোনয়ন আটকাতে কম চেষ্টা করেন নি কুণাল ঘোষ। কিন্তু কালীঘাট থেকে মনোনয়ন বের করে এনে সুদীপ দেখিয়ে দিয়েছেন, দলের ভেতরে তাঁর খুঁটির জোর কুণালের থেকে অনেক বেশি। অতীতে একাধিকবার মমতার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ মমতার প্রতি তাঁর আনুগত্য কত পুরোনো ও পরীক্ষিত, তা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেও দিনে দিনে দলে কৌলিন্য হারাচ্ছেন বেচারা কুণাল!
উত্তর কলকাতায় এবার তৃণমূলের টিকিটের বড় দাবিদার ছিলেন তাপস রায়। তাপসের সঙ্গে কুণাল ঘোষের হৃদ্যতার কথা সবার জানা। কুণালও চেয়েছিলেন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে এবার উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রতীক পান তাপসই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাপসকে নয় সুদীপকেই বেছে নেন মমতা। ক্ষোভে দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেন তাপস রায়। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে বিধায়ক পদ ত্যাগ করতে ভোলেন নি তিনি। তাপসের ছেড়ে দেওয়া বরাহনগর বিধানসভা আসনে বিজেপির প্রার্থী সজল ঘোষ। তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অভিনেত্রী সায়ন্তিকা। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই মমতার পাশে ছিলেন তাপস রায়। সুদীপের সঙ্গে বরাবরই তাঁর খাড়াখাড়ি। সাম্প্রতিক সময়ে তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছায়। লোকসভার মনোনয়ন নিয়ে মমতা তাঁকে হতাশ করতেই তৃণমূলকে ত্যাগ করতে আর দ্বিধা করেন নি প্রবীণ রাজনীতিক তাপস রায়। কিন্তু কুণাল ঘোষের সে মুরোদ নেই। তবে তিনি তলে তলে উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থীকে সহায়তা করছেন বলে গুঞ্জন। কুণালের এই ভূমিকাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালভাবে নেন নি বলে তৃণমূলের ভেতরে খবর। বুধবার সকালে একটি রক্তদান শিবিরে তাপস রায়ের সঙ্গে এক মঞ্চে হাজির ছিলেন কুণাল ঘোষ। সেখানে তিনি যে ভাষায় তাপসের গুণগান করেন, তারপর ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে মাথা ঠাণ্ডা রাখা ছিল সত্যিই মুশকিল।
বুধবার দুপুরের মধ্যেই তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত হন কুণাল। তৃণমূলের লেটারহেড প্যাডে ছাপানো যে বিবৃতি মারফত কুণালের অপসারণের খবর সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়, সেখানে স্বাক্ষর করেছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। এরপর থেকেই কুণাল ঘোষকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে হইচই। বৃহস্পতিবার দলের ‘স্টার ক্যাম্পেনার’-এর তালিকা থেকেও কুণালের নাম ছেঁটে দেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পদ খুইয়ে দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে কুণাল ঝাঁঝালো আক্রমণ শানালেও তৃণমূল ছাড়বেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর গুণকীর্তন করলে দল যে তাঁকে ছেড়ে কথা বলবে না, এই জ্ঞান কুণালের আছে। কুণাল এও জানতেন, তাঁর মুখপাত্র পদ গেছে, এই ধাক্কায় সাধারণ সম্পাদক পদটাও যাবে। কিন্তু দল তাঁকে তাড়াবে না আর তিনিও যাবেন না। মমতা ও অভিষেককে উহ্য রেখে তৃণমূলের ভেতরে যে নেতারা তাঁর শত্রু- মিডিয়ার সামনে তাঁদের গালমন্দ করাতেই কুণালের যত স্বমেহনতুল্য আনন্দ। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের একটা বাচ্চাও জানে, মমতা ও অভিষেকের নির্দেশ ছাড়া তৃণমূলে কেউ পদ পানও না, কারও পদ যায়ও না।
কুণাল ঘোষ এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে অজ্ঞান। তিনি পারলে অভিষেকের পাদোদক পান করেন। অথচ সারদা মামলায় মমতার নির্দেশেই কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করেছিল রাজ্য পুলিশ। কারা যন্ত্রণায় কাতর কুণাল যখন প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে তাঁর প্রিয় নেত্রীর বন্দনা গান গাইতেন, তখন কুণালের আওয়াজ চাপা দেওয়ার জন্য ভ্যানের গায়ে চাপড় মেরে মেরে হাতব্যথা করে ফেলতেন পুলিশ কনস্টেবলরা। সাড়ে তিন বছর জেল খেটে বেরিয়ে তাঁর দুর্ভাগ্যের যাবতীয় দায় মুকুল রায়, রাজীব কুমার আর অর্ণব ঘোষের উপর চাপিয়ে সুড় সুড় করে কালীঘাটে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন কুণাল। বুধবার পদ যাওয়ার পর কুণাল ঘোষ যে হাল্কা হাল্কা বিদ্রোহের আভাস দিয়েছিলেন শনিবার তার সমাপ্তি। ডেরেক ও’ব্রায়েনের সঙ্গে ব্রাত্য বসুর উপস্থিতিতে বৈঠকের পরেই কুণাল ‘পুনর্মুষিক ভব’। কোনওবারই কুণাল ঘোষের হালকা হালকা বিদ্রোহ তিনদিনের বেশি টেকে না।
অতীতের স্মৃতি হয়তো কুণাল ঘোষকে দগ্ধ করে। কারাবাসের কষ্ট ভোলা শক্ত। অপমানের জ্বালায় মাঝে মাঝে তাঁর বিদ্রোহ করারও সাধ জাগে মনে। কিন্তু তা কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার মতোই অবাস্তব। বারেবারেই কেঁদেকেটে বিদ্রোহ সমাপ্ত করে কুণাল ঘোষ প্রমাণ করেন, তিনি হেলে সাপ ছাড়া আর কিছুই নন। এইসব করে কুণাল হেডলাইন হন বটে কিন্তু লোকে তাঁকে ঢ্যামনা ছাড়া আর কিছু বলে না।
Feature image: collected.