পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে আইনের শাসন বলবৎ করতে প্রশাসনের অনীহা আছে, এ’কথা আমরা সবাই জানতাম। এই নিস্পৃহতার হেতু কী, তাও আমাদের অজানা নয়। তৃণমূলের রাজনৈতিক বিরোধীদের সোজাসাপ্টা অভিযোগ, ভোট বাক্সে সমর্থন হারানোর ভয়েই সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে আইনের শাসন গোল্লায় গেলেও চোখ বন্ধ করে থাকে পুলিশ। এবং পুলিশকে এই নির্দেশ সরকারের একদম শীর্ষ থেকেই দেওয়া আছে বলে শোনা যায়। শেখ শাহজাহানের মতো শাসকদলের নেতা এখন মৌজায় মৌজায় খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে একবার জায়গিরদারী পাওয়া হয়ে গেলে আর কোনও চিন্তা নেই। তখন যা খুশি তাই করার লাইসেন্স পাওয়া যায়। শুধু রাজস্বের ভাগাটা ঠিকমতো পৌঁছে দিলেই হল।
কিন্তু পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, সন্দেশখালির নির্যাতিত মহিলারা মুখ না খুললে আমরা জানতে পারতাম না। হয়তো রেশন দুর্নীতির তদন্তে ইডির আধিকারিকেরা শেখ শাহজাহানের ডেরায় হানা না দিলে তার হারেমের কথা এত দ্রুত জন সমক্ষে প্রচারিত হত না। ইডির আধিকারিকদের উপরে হামলার পর থেকেই শাহজাহান তার সাম্রাজ্য ফেলে ফেরার। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যে লোকের সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে ঢুকে নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ, এখনও পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যয় করেন নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি একজন নারী!
সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানের সাম্রাজ্যে ঘরের বউ-মেয়েদের উপর যেটা এতদিন ধরে ঘটেছে, সেটা কোনও বিচ্ছিন্ন নারীঘটিত অপরাধ নয়। এটা সেই মধ্যযুগীয় ত্রাসের রাজত্ব, যেখানে নারীর সম্ভ্রম পিতা-স্বামী-ভায়ের সম্মুখে অবাধে লুন্ঠন করে থাকে সমাজের প্রভাবশালী প্রভুরা। এইসব ঘটনা এতদিন সংবাদ মাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে আসে নি। তার অর্থ এটা নয় যে কেউ জানতো না। সন্দেশখালির মতো সুন্দরবন বদ্বীপের এলাকাগুলি ভৌগলিকভাবে যত দুর্গমই হোক, কলকাতা থেকে বেশি দূরত্বে নয়। এবং সে’সব এলাকাতেও থানা-পুলিশ-প্রশাসনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সন্দেশখালিতে রাত নামলেই ঘরে ঘরে শেখ শাহজাহানের লোকেরা ঢুকে মেয়ে-বউদের তুলে নিয়ে যেতো, আর এইসব ঘটনা পুলিশের কর্ণগোচর হয় নি, তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। এলাকার অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মহিলারা মুখ খোলার পর জানা যাচ্ছে, পুলিশের সামনেই নারীর ইজ্জত লুঠ করত শাহজাহান বাহিনী।
শেখ শাহজাহানদের দুষ্কর্মের কথা পুলিশ জানতো আর নবান্ন কিম্বা কালীঘাটে সেই খবর পৌঁছায় নি, এই কথাও কি মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে? যদি সত্যি সত্যিই সন্দেশখালিতে নারীদের উপরে নারকীয় নির্যাতনের ঘটনা রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে না পৌঁছে থাকে, তবে তা প্রশাসনের ব্যর্থতা। আর রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ সব ঘটনা জানার পরেও যদি নিশ্চেষ্ট থেকে থাকেন, তবে তাঁকেও সমান অপরাধী বলতে আমাদের ঠোঁট কাঁপবে না। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা ধার করে বলি- “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।” ভোটের জন্য সরকার প্রধান রাজধর্ম শিকেয় তুলেছেন কবেই, তা বলে ঘরের মা-বোনেদের উপর অত্যাচার হলেও ঘটনা আড়াল করতে হবে?
ঘটনাচক্রে সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানের অত্যাচারের কাহিনী উন্মোচিত হয়েছে কিন্তু আরও কত সন্দেশখালিতে একই ঘটনা ঘটে গেছে বা ঘটে চলেছে, কে জানে! এখন বাংলায় শেখ শাহজাহান তো একটা কিম্বা একজোড়া নয়। সন্দেশখালি একটা সিন্ড্রোম! শেখ শাহজাহানও একটা সিন্ড্রোম! ভয়ঙ্কর খারাপ একটা উপসর্গ। দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে পশ্চিমবঙ্গের সামনে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। চিকিৎসা করবেন না উপেক্ষা করবেন?
Feature graphic is representational.