শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করা রাজনৈতিক দলগুলির সাংবিধানিক অধিকার। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, যে কোনও সংগঠনকে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে সংবিধান। পরিস্থিতি সাপেক্ষে কাউকে অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার ক্ষমতা পুলিশের অবশ্যই আছে। কিন্তু একই স্থানে কোনও দলকে সভা করতে দেবো আবার অন্য দলকে দেবো না- এই বৈষম্য করার অধিকার পুলিশকে কেউ দেয় নি। কলকাতার ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করতে চায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি। আগামী ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় সেই সভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তৃতা দেওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশের কাছে বিধি মাফিক সভার অনুমতি চেয়েও পান নি রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব।
পর পর দু’বার কোনও কারণ না জানিয়ে বিজেপির আবেদন খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা পুলিশ। যুক্তিযুক্ত কারণ সহ পুলিশ আবেদন খারিজ করতেই পারে। কিন্তু কলকাতা পুলিশের হাতে তো কোনও যুক্তি নেই। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে তারা কোনও যুক্তিও দেখায় নি। ওই ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই প্রত্যেক বছর একুশে জুলাই তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একুশে জুলাই দলের শহিদ দিবসে ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে বাম আমল থেকে সভা করে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ধর্মতলায় একুশে জুলাইয়ের সভা সরকারি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলা চলে। বছর বছর সেই সভার বহর ও জেল্লা বাড়ছে। রাজ্যের মানুষের প্রশ্ন- তাহলে অন্য কোনও দল কেন একই জায়গায় সভা করতে পারবে না?
পুলিশের থেকে অনুমতি না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। সাধারণ মানুষের যে প্রশ্ন আদালতেরও সেই প্রশ্ন। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা কলকাতা পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছেন, কোন প্রেক্ষিতে পর পর দু’বার ধর্মতলায় বিজেপির সভার আবেদন নামঞ্জুর করা হল? গত সোমবার মামলার শুনানি চলাকালে বিচারপতি মান্থা বলেছেন, ‘‘স্বাধীন দেশে মানুষ যেখানে মন চায় যাবে। কোনও কারণ ছাড়াই পর পর দু’বার সভার অনুমতি বাতিলের কারণ কী? অনুমোদন বাতিলের দু’টি চিঠি দিয়েছে পুলিশ। অথচ একটিতেও আপত্তির কারণ লেখা নেই। খুব বিস্মিত হচ্ছি পুলিশের এমন জবাব দেখে। কী শর্ত দেবে সেটা পুলিশ ঠিক করুক। কিন্তু অনুমতি দিতে হবে পুলিশকেই। সবার সমানাধিকার থাকা উচিত। কোনও কারণ না দেখিয়ে দু’বার অনুমতির আবেদন খারিজ করা হয়েছে। এতেই সন্দেহের উদ্রেক হয়।’’
সোমবারই সিঙ্গেল বেঞ্চে মুখ পুড়েছিল কলকাতা পুলিশের। বৃহস্পতিবার ছিল মামলার পরবর্তী শুনানি। কিন্তু তার আগেই ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করে বসে আছে রাজ্য সরকার। বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টিকে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ করে ফেলেছে নবান্ন। মুখ্যমন্ত্রী কি চান না, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়ে থাকেন, সেখানে দাঁড়িয়ে অন্য কোনও দলের নেতা ভাষণ দেন? পুলিশ প্রশাসন কোনও দলের নয়। পুলিশের দায়িত্ব সংবিধান মেনে আইনের শাসন কায়েম রাখা। পুলিশের কাছে শাসকদল-বিরোধীদল সবাই সমান। কিন্তু শাসকদলের চাপের কাছে নতজানু হয়ে পুলিশকে সংবিধান বহির্ভূত কাজ করতে হয় হরহামেশাই। ধর্মতলায় বিজেপির সভার প্রশ্নেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্জিতে একপেশে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ, এমনই অভিযোগ সুকান্ত মজুমদার-শুভেন্দু অধিকারীদের। পুলিশের হয়েছে ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা! আদালতে মুখ থাকবে না জেনেও শাসকদলের সুপ্রিমোর নির্দেশে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাদের।
শুক্রবার প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে ধর্মতলা সভা মামলার শুনানি। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের আশা, ডিভিশন বেঞ্চেও সুবিচার পাবেন তাঁরা। ধর্মাবতাররা ধর্মতলা নিয়ে ন্যায় প্রদান করবেন নিশ্চয়ই। রাজ্যের সাধারণ মানুষের মতামত খুব স্পষ্ট। মানুষ মনে করেন, ধর্মতলা কারও বাপের নয়। গণতান্ত্রিক দেশে সবার সমানাধিকার। হয় সব দলকেই ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করতে দিতে হবে নচেৎ সেখানে কাউকেই সভা করতে দেওয়া চলবে না।