নিজ্জর হত্যাকান্ড: ৩ মাসেও তদন্তে অগ্রগতি নেই, কীসের ভিত্তিতে ভারতকে জড়ালেন ট্রুডো? - nagariknewz.com

নিজ্জর হত্যাকান্ড: ৩ মাসেও তদন্তে অগ্রগতি নেই, কীসের ভিত্তিতে ভারতকে জড়ালেন ট্রুডো?


বিশেষ প্রতিবেদন: গণতন্ত্রে ভোট বড় বালাই। তাই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে মাত্র ২ শতাংশ শিখ ধর্মাবলম্বীর জন্য ভারতের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করার মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হল। কানাডার জনসংখ্যা মাত্র ৩ কোটি ৭০ লক্ষ। তাঁর মধ্যে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ ৭ লক্ষ ৭০ হাজার। কানাডা আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। কিন্তু জনসংখ্যায় ৩৭তম। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে কানাডায় মাত্র ৪.২ জন বাস করে। জনঘনত্বে বিশ্বে কানাডার অবস্থান ২৩৬ এ। মাত্র ২ শতাংশ হলেও স্বল্প জনসংখ্যার কানাডার রাজনীতিতে শিখদের কদর কম নয়।‌ শিখরা বরাবরই ট্রুডোর লিবারেল পার্টি ঘেঁষা। কানাডায় বসবাসরত শিখদের একটা বড় অংশ বহুদিন ধরেই খালিস্তানপন্থী। কানাডার খালিস্তানপন্থী শিখেরা অবাধেই রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। এ নিয়ে ভারতের আপত্তি থাকলেও কানাডা সরকারের বক্তব্য, তারা কোন‌ও জনগোষ্ঠীর মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী নয়।

ট্রুডোর আমলে কানাডায় খালিস্তানিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে

জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টির সংখ্যালঘু সরকার টিকে আছে নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থনে। নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান জগমিত সিংকে ২০১৩ সালে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল ইউপিএ সরকার। ভারত সরকারের অভিযোগ ছিল, দেশের সামাজিক কাঠামোর বিনষ্টকারী শক্তিকে মদত দেওয়ার কাজে যুক্ত আছেন জগমিত। গত ১৮ জুন কানাডার সারে এলাকায় গুরু নানক শিখ গুরুদ্বার সাহিব চত্বরের পার্কিং লটে দু’জন অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত হন হরদীপ সিং নিজ্জর। নিজ্জর ছিলেন গুরুনানক শিখ গুরুদ্বার সাহিবের প্রধান এবং খালিস্তান টাইগার ফোর্সের শীর্ষনেতা। ভারত সরকারের চোখে খালিস্তান টাইগার ফোর্স সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। সেই সুবাদে ভারতের কাছে নিজ্জর একজন সন্ত্রাসবাদী।

ট্রুডোর আমলে ইন্দিরার হত্যাকান্ডকে গৌরবান্বিত করে ট্যাবলো পর্যন্ত বের করছে কানাডার খালিস্তানপন্থীরা। ছবি- সংগৃহীত

সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় ভারত বিরোধী শিখ সংগঠনগুলির তৎপরতা চোখে পড়ার মতোই বেড়েছে। চলতি বছরের ২০ মার্চ অটোয়ায় কানাডার ভারতীয় দূতাবাসে হামলা চালিয়েছিল খালিস্তানপন্থীরা। অপারেশন ব্লুস্টারের ৩৯তম বার্ষিকী উপলক্ষে গত ৪ জুন খালিস্তানপন্থীরা কানাডার ব্র্যাম্পটন শহরে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ডকে গৌরবান্বিত করে একটা কুৎসিত ট্যাবলো বের করেছিল। বিনা বাধায় পাঁচ কিলোমিটার পথ প্রদক্ষিণ করেছিল ট্যাবলোটি। ভারতের তরফে ঘটনাটির তীব্র প্রতিবাদ জানানো হলেও ট্রুডো সরকার আয়োজকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে নি। ট্রুডো এখন বলছেন, হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হাত আছে। তদন্তে নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাত থাকার প্রমাণ মিলেছে বলে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন জাস্টিন ট্রুডো।‌ ‘র’-এর জড়িত থাকার ঠিক কী কী প্রমাণ মিলেছে, কানাডা সরকার তা না জানালেও অটোয়ার ভারতীয় দূতাবাসের বরিষ্ঠ কূটনীতিক পবনকুমার রাইকে বহিষ্কার করতে দেরি করে নি। পবনকুমার ১৯৯৭ ব্যাচের আইপিএস এবং ‘র’-এর প্রাক্তন প্রধান। কানাডার ভারতীয় দূতাবাসের ইন্টেলিজেন্স উইংসের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

ভারতকে অভিযুক্ত করার মতো তথ্যপ্রমাণ নেই কানাডার

অদ্ভুত ব্যাপার হল, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের দায় ভারতের উপর চাপিয়ে ঘটনার তদন্ত করার জন্য আবার ভারত সরকারকেই পীড়াপীড়ি করছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন জাস্টিন ট্রুডো। সেই সময় মোদীর সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে ট্রুডো বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন বলে দুই দেশের তরফেই স্বীকার করা হয়েছে। যে ঘটনার দায় ভারত দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করেছে, সেই ঘটনার তদন্তের দাবি যে নয়াদিল্লি পত্রপাঠ খারিজ করে দেবে তা জানা কথাই। হরদীপ সিং নিজ্জর খুন হ‌ওয়ার পর থেকেই কানাডার মিডিয়ায় ভারতকে নিয়ে চর্চা। অথচ ঘটনার তিনমাস পরেও তদন্তে বিশেষ কোনও অগ্রগতি হয় নি। দুই মুখোশধারী আততায়ী নিজ্জরকে গুলি করে ঘটনাস্থল থেকে হেঁটে বেরিয়ে গিয়ে খানিকটা দূরে অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে চম্পট দেয়। এখনও পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারে নি কানাডার পুলিশ। ‘ইন্টিগ্রেটেড হোমিসাইড ইনভেস্টিগেশন টিম’ ঘটনার তদন্তে নেমে উল্লেখ করার কোনও তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে ব্যর্থ। তাহলে কীসের ভিত্তিতে নিজ্জর খুনে ভারতের ‘র’-এর দিকে আঙুল তুলছে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সরকার?

নিহত খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের নাম এন‌আইএ-র ওয়ান্টেড তালিকায় ছিল।

এটা সত্যি যে ভারত সরকারের ঘোষিত সন্ত্রাসবাদীদের তালিকায় কেটিএফ প্রধান হরদীপ সিং নিজ্জরের নাম ছিল এবং ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এন‌আইএ) তাঁকে খুঁজছিল। কিন্তু তাতে এটা প্রমাণ হয় না, ভারতের গোয়েন্দারাই নিজ্জরকে নিকেশ করেছে। অনুমানের বশে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে দোষী সাব্যস্ত করে ভারত সরকারকেই ঘটনার তদন্ত করতে বলাটা ট্রুডোর জন্য ‘ছেলেমানুষী’ হয়ে গেল না? নিজের সংখ্যালঘু সরকারকে বাঁচাতে শিখ জনগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দল নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে তুষ্ট করার বাধ্যবাধকতা ট্রুডোর রয়েছে। হরদীপ সিং নিজ্জর খালিস্তানপন্থী শিখদের ভেতরে নিঃসন্দেহে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। নিজ্জরের নিধনে ট্রুডো সরকারের উপরে শিখদের তরফে যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই চাপ হাল্কা করতেই জাস্টিন ট্রুডো নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের নাম জড়িয়ে দিয়েছেন বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।

ট্রুডোর অপরিপক্ক রাজনীতি, বিড়ম্বনায় বাইডেন

ভারতীয় কূটনীতিককে পাঁচ দিনের ভেতরে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়ে কানাডা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আচমকাই যে জায়গায় নিয়ে গেছে, তাতে নয়াদিল্লির নমনীয় থাকার আর কোনও সুযোগ নেই। বদলা নিতে দিল্লির কানাডা দূতাবাসের গোয়েন্দা প্রধানকেও বহিষ্কার করতে বিলম্ব করে নি মোদী সরকার। কানাডার অভিযোগ ভারত মানে নি। সাউথ ব্লকের পাল্টা অভিযোগ, ২১ জন ‘ওয়ান্টেড’ খালিস্তানি জঙ্গি ট্রুডো সরকারের নিরাপদ ছত্রছায়ায় কানাডায় আছে। কানাডার নাগরিকদের ভিসা প্রদান পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে ভারত। স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমী বিশ্বের কোনও দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের এমন অবনতির নজির নেই। চিনকে মোকাবিলা করতে আমেরিকা যখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আর দৃঢ় করতে উদগ্রীব তখন নিজ্জর হত্যাকান্ড ঘিরে ট্রুডোর অপরিপক্ক রাজনীতি বাইডেন প্রশাসনকে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য যথেষ্ট।

Feature Graphic is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *