বিশেষ প্রতিবেদন: ধূপগুড়ি ধরে রাখতে ব্যর্থ বিজেপি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর শুক্রবার শেষ হাসি হাসল তৃণমূলই। গত ২৫ জুলাই বিজেপির বিধায়ক বিষ্ণুপদ রায়ের মৃত্যুতে ধূপগুড়ি সংরক্ষিত বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর)। রাজবংশী জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত ধূপগুড়ি পদ্মফুলের দখলেই থাকে নাকি ফের ঘাসফুলের নিয়ন্ত্রণে আসে, সেই দিকে নজর ছিল গোটা রাজ্যের। উপনির্বাচনের ফল সাধারনত শাসকদলের পক্ষেই যায়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে ধূপগুড়ি ধরে রাখতে জান লড়িয়ে দিয়েও শেষরক্ষা করতে পারলেন না রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে বিজেপির তাপসী রায়কে ৪,৩০৯ ভোটে পরাজিত করলেন তৃণমূল প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায়। নির্মল পেয়েছেন ৯৭ হাজার ৬১৩টি ভোট। তাপসীর ঝুলিতে ৯৩ হাজার ৩০৪।
ডুয়ার্সের কৃষিবলয় ধূপগুড়িকে বলা হত বামদুর্গ। এগারোর পালা বদলের ভোটেও ধূপগুড়ি হারায় নি সিপিএম। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের থেকে ধূপগুড়ি ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। বামেদের এক সময়ের দুর্ভেদ্য দুর্গে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বিজেপিও। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির লিড ছিল প্রায় ১৮ হাজারের। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ধূপগুড়ি তৃণমূলের হাতছাড়া হয়। বিজেপির বিষ্ণুপদ রায় তৃণমূলের মিতালি রায়কে হারিয়ে ছিলেন ৪,৩৫৫ ভোটে। উনিশের লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গের ৮ আসনেই বিপর্যস্ত হয়েছিল তৃণমূল। দু’বছর পরে বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ফল তুলনামূলক ভাল হলেও ডুয়ার্স-তরাইয়ের রাজবংশী ও উপজাতি বেল্টে পদ্মফুলের কাছে সুবিধা করতে পারে নি ঘাসফুল। লোকসভা নির্বাচনের আগে তাই রাজবংশী অধ্যুষিত ধূপগুড়ি বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিতে উপনির্বাচনে সর্বশক্তি দিয়ে লড়েছিল তৃণমূলও।
লড়াই আবার দুই ফুলে, জোটের জামানত জব্দ
ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে জোটের ভোটের দিকেও তাকিয়ে ছিল রাজনৈতিক মহল। ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জোটের প্রার্থী সিপিএমের ঈশ্বরচন্দ্র রায় একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারেন বলে অনুমান করেছিলেন অনেকে। কিন্তু শুক্রবার গণনার দুই রাউন্ড পর থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে লড়াইটা দ্বিমুখী- সরাসরি বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের। সিপিএম প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার ৭৫৮টি। মাত্র ৬.৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জামানত খুইয়েছেন তিনি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ধূপগুড়ি আসনে সিপিএমের ভোট ছিল ৫.৭৩ শতাংশ। জোটের ভোট বেড়েছে মাত্র ০.৭৯ শতাংশ। জুলাইয়ের পঞ্চায়েত ভোটেও ধূপগুড়িতে জেলা পরিষদ স্তরে বাম-কংগ্রেসের দখলে ছিল ১২.১০ শতাংশ ভোট। উপনির্বাচনে পঞ্চায়েতের ভোট ধরে রাখতেও জোট ব্যর্থ।
ধূপগুড়ি উপনির্বাচন থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, ভোটাররা হয় তৃণমূল নয় বিজেপির মধ্যে একটিকে পছন্দ করেছেন, জোটকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন নি। তাই দিনের শেষে ধূপগুড়ি হারালেও বিজেপির ভোট খোয়ানোর হার সামান্যই। একুশের নির্বাচনে ধূপগুড়ি বিধানসভায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৪৫.৬৫ শতাংশ। উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট ৪৪.২৩ শতাংশ। পদ্ম শিবিরের ভোট কমেছে মাত্র ১.৪২ শতাংশ। একুশে ধূপগুড়িতে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৩.৭৫ শতাংশ। উপনির্বাচনে ভোট বেড়ে হয়েছে ৪৬.২৮ শতাংশ। তৃণমূলের ভোট বৃদ্ধি ২.৫৩ শতাংশ। পঞ্চায়েত ভোটে ধূপগুড়িতে জেলা পরিষদ স্তরে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৪৭.৬০ শতাংশ। উপনির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কমেছে ১.৩২ শতাংশ। জেলা পরিষদ স্তরে বিজেপির ভোট ছিল ৩৯.২০ শতাংশ। উপনির্বাচনে হারলেও বিজেপির ভোট বাড়ল ৫.০২ শতাংশ। ধূপগুড়িতে জেলা পরিষদে জোট পেয়েছিল ১২.১০ শতাংশ ভোট। উপনির্বাচনে কমে হয়েছে ৬.৫২ শতাংশ। পঞ্চায়েতের তুলনায় জোটের কমেছে ৫.৫৮ শতাংশ ভোট। বাম-কংগ্রেসের হ্রাস আর বিজেপির বৃদ্ধি প্রায় সমান। অর্থাৎ ৮ জুলাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে যারা জোটের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের অর্ধেক ৫ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনে বিজেপিকে ভরসা করেছেন।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে গড় হারাল বিজেপি?
মাটি কামড়ে পড়ে থেকেও ধূপগুড়ি রক্ষা করতে ব্যর্থ সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা। প্রার্থী বাছাই নিয়ে শুরু থেকেই গেরুয়া শিবিরে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। সব পক্ষের ক্ষোভ ধামাচাপা দিতে শেষে মনোনয়ন দেওয়া হয় দলের বাইরে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ানের বিধবা স্ত্রীকে। দলের ভেতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চাপা দেওয়া ও দেশপ্রেমের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোট বৈতরণী পার- এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার মিছিলে দলের বহিষ্কৃত নেতা অলোক চক্রবর্তীকে রাস্তায় ফেলে জেলা বিজেপি সভাপতির লাথি মারার দৃশ্য ভাইরাল হতেই রাজনৈতিক মহলে ঢি ঢি পড়ে যায়। ভোটের তিনদিন আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে পতাকা নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন জলপাইগুড়ি জেলা বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দীপেন প্রামাণিক। জলপাইগুড়ি জেলা বিজেপির বর্তমান সভাপতি বাপী গোস্বামীর সঙ্গে ঠোকাঠুকি চরমে ওঠাতেই দীপেনের ফুল বদল। ধূপগুড়ির গেরুয়া শিবিরে এখনও আদি বিজেপি দীপেন প্রামাণিকের অনুগামীর সংখ্যা কম নয়। ধূপগুড়িতে বিজেপির হারের পেছনে ভোটের মুখে দীপেনের দলত্যাগ একটা কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মিতালি এফেক্টে পদ্মের ভোট না বেড়ে কমল!
দীপেন প্রামাণিকের তৃণমূলের যোগদানের ২৪ ঘন্টা পেরোনোর আগেই ভোট প্রচারের অন্তিম দিনের সকালে রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের হাত ধরে পদ্ম শিবিরে ভেড়েন ধূপগুড়ির প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক মিতালি রায়। আগের দিন বিকেলে তৃণমূলের মঞ্চে অভিষেকের গলায় উত্তরীয় পরিয়ে পরের দিন সকালে মিতালির বিজেপিতে যোগ দানের ঘটনায় সবাইকে তাজ্জব করে দিয়েছিল। তৃণমূল উপনির্বাচনে প্রার্থী না করায় মিতালির মনে ক্ষোভ ছিল। কলকাতা থেকে অরূপ বিশ্বাস ছুটে এসেও মিতালির ক্ষোভ প্রশমনে ব্যর্থ হন। দীপেন প্রামাণিককে তৃণমূলে নেওয়ার বদলা নিতে রাতারাতি মিতালি রায়কে বিজেপিতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুকান্ত-শুভেন্দুরা। মিতালি রায় একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় উপনির্বাচনে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব মিতালির নাম প্রার্থী হিসেবে বিবেচনার মধ্যেই আনে নি বলে ভেতরের খবর। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত একজন প্রাক্তন বিধায়ক, যিনি আগের নির্বাচনে পরাজিত, তাঁকে দলে নেওয়ায় জেলা বিজেপির অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে মিতালিকে দলে নিয়ে বিজেপির ভোট তো বাড়েই নি বরং কমেছে বলেই ফল ঘোষণার পর মনে করছেন কেউ কেউ।
মহকুমা তাস খেলে অভিষেকের বাজিমাত
২ সেপ্টেম্বর একদিনের জন্য ভোট প্রচারে ধূপগুড়িতে এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চ থেকেই তিন মাসের মধ্যে ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দেন অভিষেক। অভিষেকের ‘মহকুমা তাস’ কাউন্টার করার মতো কোনও তাস বিজেপি নেতাদের হাতে ছিল না। শেষ বাজারে অভিষেকের মুখে তিন মাসের মধ্যে মহকুমার আশ্বাসই যে তৃণমূলের ধূপগুড়ি জয়ের রাস্তা অনেকটাই প্রশস্ত করে দিয়েছে, ভোটের ফলেই তার প্রমাণ। রাজবংশী অধ্যুষিত বিজেপির ঘাঁটিতে ঘাসফুলের জয় লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তরবঙ্গের তৃণমূল নেতৃত্বকে যে উজ্জীবিত করবে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
Feature image is representational.