পঞ্চায়েত ভোট মামলা: শুনানি শেষে রায়ের প্রতীক্ষা, হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে আশা দেখছেন বিরোধীরা - nagariknewz.com

পঞ্চায়েত ভোট মামলা: শুনানি শেষে রায়ের প্রতীক্ষা, হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে আশা দেখছেন বিরোধীরা


কলকাতা: রাজ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ভরসা একমাত্র আদালত।‌ এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সোমবার দু’দফায় দিনভর পঞ্চায়েত মামলার শুনানি শেষে রায়দান স্থগিত রাখল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। মনোনয়ন জমা করার দিন বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় ভোটগ্রহণ, বুথের ভেতরে ও বাইরে সিসি ক্যামেরার নজরদারি, সিভিক পুলিশ ও চুক্তি ভিত্তিক কর্মীদের ভোটের ডিউটির বাইরে রাখা সহ পাঁচদফা আর্জি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে বিরোধীরা। ভোটের ডিউটি করার সময় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় সরকারি কর্মচারীরাও। বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন চেয়ে ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছে সরকারী কর্মচারীদের সংগঠন‌ও। হাইকোর্ট সোমবার রাতেই কিম্বা মঙ্গলবার সকালে রায় জানিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। এদিকে এ’দিন‌ও মনোনয়ন ঘিরে অশান্তির খবর এসেছে রাজ্যের নানা দিক থেকে।

আদালতের পর্যবেক্ষণে খুশি শুভেন্দু

আদালত পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রায় স্থগিত রাখলেও প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে খুশি বিরোধী শিবির। মামলার শুনানিতে হাজির থাকতে সকালে হাইকোর্টে চলে‌ আসেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। প্রথম দফার শুনানি শেষে মধ্যাহ্ন বিরতিতে আদালত চত্বর থেকে ফিরে যাওয়ার আগে বিরোধী দলনেতা বলেন, “সুষ্ঠু ভোট করতে আদালত‌ই ভরসা। হাইকোর্ট অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত ভোটের স্বার্থে মামলাকারীদের ভূমিকাকে যে ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে তাতে আমি খুশি।” পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু করার দিকে লক্ষ্য রেখে‌ই আদালত নির্দেশ দেবে বলে আশাবাদী শুভেন্দু অধিকারী।

১৪ জুলাই ভোট করার প্রস্তাব ডিভিশন বেঞ্চের

হঠাৎ করে গত বৃহস্পতিবার (৮ জুন) বিকেলে পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। শুক্রবার (৯ জুন) নোটিফিকেশন জারি ও মনোনয়ন জমা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। সাতদিন মনোনয়ন জমা করার সময় দেওয়া হলেও রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় সেদিন মনোনয়ন তোলা ও জমার ব্যবস্থা রাখা হয় নি। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা করার সময়। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ৭৪ হাজার আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য মাত্র ২৪ ঘন্টা সময় বরাদ্দ করা হয়েছে বলে আদালতে অভিযোগ করেন মামলাকারীদের আইনজীবীরা। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মেনে নেয় নি প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ‌ও। শুক্রবারের মতো সোমবার‌ও শুনানি চলাকালে একাধিক বিষয়ে মন্তব্য করেন ও নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্য। প্রধান বিচারপতি বলেন, “ভোটের দিন ৮ জুলাই থেকে পিছিয়ে ১৪ জুলাই করা যেতে পারে।” ডিভিশন বেঞ্চের প্রস্তাব, ১৫ জুন থেকে নতুন করে মনোনয়ন পর্ব শুরু হোক, ২১ জুন হোক মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। ২৩ জুন স্ক্রুটিনি ও ২৬ জুন হোক মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। নতুন সূচি অনুযায়ী সব কিছু চললে ভোটের দিন ৮ জুলাই থেকে পিছিয়ে ১৪ জুলাই করতে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম।

সিভিকে কড়া আপত্তি আদালতের

পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিরোধীদের উৎকণ্ঠাকে আদালত যে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ তার প্রমাণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ভোটের নিরাপত্তা বিরোধীদের সবথেকে বড় উদ্বেগের জায়গা। বিরোধীরা মনে করছে, রাজ্যের ৬১ হাজার ৬৩৬টি ভোটকেন্দ্রে দু’জন করে সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করার মতো জনবল নেই রাজ্য পুলিশের। ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন দাবি করছে বাম-বিজেপি ও কংগ্রেস। সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভোটের কাজে লাগানোর ব্যাপারেও আপত্তি আছে বিরোধীদের। দু’দিন‌ই শুনানি চলাকালে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধীদের উদ্বেগকেও গুরুত্ব দিয়েছেন বিচারপতিরা। সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভোটের কাজে রাখার বিষয়ে নিজের আপত্তির কথা সোমবার স্পষ্ট করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম বলেন, “আমরা চাই, কোনও সিভিক ভলান্টিয়ার বা চুক্তিভিত্তিক কর্মী কোন‌ও ভাবেই এই নির্বাচনে যেন অংশ না নেন। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাদ রাখা হোক। কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করে দেখুক।” নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আদালতকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভোটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ডিউটি থেকে দূরে রাখা হবে। তবে বিভিন্ন দফতরের চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের তারা ভোটের অন্যান্য কাজে লাগাতে চায় বলে ডিভিশন বেঞ্চকে জানিয়েছেন কমিশনের আইনজীবী। আদালত চাইলে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৫ জুনের পরিবর্তে ১৬ জুন এবং মঙ্গলবার থেকে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার সময় একঘন্টা বৃদ্ধি করতে তাদের অসুবিধা নেই বলে আদালতকে জানিয়েছে কমিশন। তবে ডিভিশন বেঞ্চের প্রস্তাব মতো ভোটের দিন পিছিয়ে দিতে রাজি হয় নি নির্বাচন কমিশন।

কেন্দ্রীয় বাহিনী চায় হাইকোর্ট‌ও, আপত্তি কেন কমিশনের?

তিন বিরোধী পক্ষের পাশাপাশি রাজ‌্য সরকারি কর্মচারীদের‌ও দাবি, পঞ্চায়েত ভোটে বুথে নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতেই থাকুক। সোমবার শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতিও নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রস্তাব দেন, পঞ্চায়েত ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে করালেই ভাল হয়। তিনি বলেন, “হনুমান জয়ন্তীর সময় আমরা বলেছিলাম, সাধারণ মানুষের মনোবল বাড়াতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে। তারা রাজ্যকে সহযোগিতা করতেই এসেছিল। পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রেও কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহযোগিতা চাইতে পারে। ” প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, “কমিশন ৬ থেকে ১০টি জেলাকে স্পর্শকাতর ঘোষণা করেছে। প্রয়োজনে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখা যেতে পারে। নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করলেই ভাল‌ হয়।” হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব দিলেও কমিশনের আইনজীবী তাতে তীব্র আপত্তি জানান। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রশ্নে কমিশনের এই অবস্থানকে রহস্যময় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কমিশনের আইনজীবী আদালতকে জানান, “কোর্ট এ’ভাবে কমিশনকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কথা বলতে পারে না।” গতবারের পুরভোটের উদাহরণ টেনে কমিশনের আইনজীবীর যুক্তি, পুরভোটেও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে কমিশনকে স্বাধীনতা দিয়েছিল আদালত।” কিন্তু পাল্টা কমিশনকে প্রধান বিচারপতি বলেন, “পুরভোটের সময় হাইকোর্ট বলেছিল, অশান্তি হলে তার দায় নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। পুরভোটে অশান্তি হয়েছিল বলেই শুনেছি। কমিশন কি দায় নিয়েছিল?”

মনোনয়ন থেকে নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন- পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে স্বস্তিতে নেই রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন। অন্য দিকে বিচারপতিদের এইসব পর্যবেক্ষণ‌ই আস্বস্ত রেখেছে বিরোধী নেতাদের।‌ তবে শুনানি চলাকালে বিচারপতিদের মন্তব্য আর নির্দেশ এক কথা নয়। কাজেই পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে আদালত শেষ পর্যন্ত কী রায় দেয়, এখন সেই দিকেই তাকিয়ে সব পক্ষ।

Feature Image is Representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *