কর্নাটকে ছুটল কংগ্রেসের বিজয়রথ, আসন অনেক খুইয়ে‌ও বিজেপির ভোট কমল সামান্য‌ই - nagariknewz.com

কর্নাটকে ছুটল কংগ্রেসের বিজয়রথ, আসন অনেক খুইয়ে‌ও বিজেপির ভোট কমল সামান্য‌ই


বিশেষ প্রতিবেদন: দীর্ঘদিন পর ফের বড় রাজ্যে উড়ল কংগ্রেসের বিজয় নিশান। এক্সিট পোলে পূর্বাভাস ছিল‌ই। কিন্তু দক্ষিণী রাজ্য কর্নাটকে প্রত্যাশা ছাপিয়ে জয় পেল হাত শিবির। নিঃসন্দেহে লোকসভা নির্বাচনের আগে বেশ খানিকটা অক্সিজেন পেলেন কংগ্রেস ব্রিগেডের সর্বাধিনায়ক রাহুল গান্ধী। দক্ষিণ ভারতে একমাত্র কর্নাটকেই ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে বিজেপি। যদিও এই রাজ্যে কখনও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নি পদ্ম শিবির।‌ কর্নাটকের রাজনীতিতে গত চার দশকের মধ্যে একমাত্র রামকৃষ্ণ হেগড়ে ছাড়া আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয় নি। ট্র্যাডিশন ভেঙে ক্ষমতায় ফেরা হল না বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের‌ও।

মোদীর ম্যাজিক সব সময় কাজ দেয় না

হাওয়া যে ভাল নয়, দিল্লিতে বসে তা টের পেয়েছিলেন মোদী-শাহ‌ও। একে কর্নাটকের ভোটদাতাদের চিরাচরিত প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাব তার উপর দলের ভেতরে প্রবল গোষ্ঠী কোন্দল। উত্তরপ্রদেশ, অসম ও মধ্যপ্রদেশ বাদ দিলে এখন অনেক রাজ্যেই বিজেপিতে জনপ্রিয় মুখের বড় অভাব। কর্নাটক‌ও ব্যতিক্রম নয়। দল কর্নাটকে ক্ষমতায় ফিরলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট‌ই দোলাচলে ছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দল ভোটে জিতলে বাসবরাজ বোম্মাইকে সরিয়ে বিএস ইয়েদুরাপ্পাকেই ফের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে কর্নাটক বিজেপির অন্দরে একটা কানাঘুষা চলছিল। স্থানীয় স্তরে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আর দলের ভেতরে প্রবল গোষ্ঠী কোন্দল- এই দুই সামাল দিয়ে কর্নাটকে ক্ষমতায় ফিরতে বিজেপির ভরসা ছিল সেই মোদীর ক্যারিশ্মার উপরেই। কিন্তু শুধু মোদী ম্যাজিকেই যে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির বৈতরণী পার সম্ভব নয়, গত কয়েক বছরে একাধিক বিধানসভা নির্বাচনে সেই প্রমাণ মিলেছে। কর্নাটকে বিজেপি ধরাশায়ী হতেই তাই আর‌ও একবার মোদীর ক্যারিশ্মা নিয়েই টানাটানি শুরু করে দিয়েছে রাজনৈতিক মহল।

কর্নাটকে কখনও জনভিত্তি হারায় নি কংগ্রেস

গোষ্ঠী কোন্দল কর্নাটক কংগ্রেসেও কম নয়। দুই শীর্ষ নেতা সিদ্ধারামাইয়া ও ডিকে শিবকুমারের মধ্যে এক সময় মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কংগ্রেসের কর্নাটকে ক্ষমতায় ফেরার মরীয়া তাড়া ছিল। কর্নাটক বরাবরই কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের অনেক হেভিওয়েট নেতা এসেছেন এই রাজ্য থেকেই। জাতীয় কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গেও কন্নড়। সাতাত্তরে ভরাডুবি এমনকি উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি আসনে রাজনারায়ণের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর কর্নাটকের চিকমাগালুর থেকে উপনির্বাচনে জিতে সংসদে ফিরেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের একাধিক বড় ও মাঝারি রাজ্যেই কংগ্রেসের পায়ের নিচের জমি কেড়ে নিয়েছে আঞ্চলিক দলগুলি। কিন্তু কর্নাটকে জনভিত্তি অটুট রাখতে পেরেছে কংগ্রেস।

কুমারস্বামীর কিং মেকার হ‌ওয়া হল না

রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দশটি দিন পার করেছে কর্নাটকে। রাহুলের যাত্রাপথে সবথেকে বেশি সাড়া মিলেছিল কর্নাটক থেকেই। কর্নাটকের রাজনীতিতে জাতপাত ও গোষ্ঠী বরাবরই বড় ফ্যাক্টর। কন্নড়ভাষী হিন্দু জনগোষ্ঠী মূলতঃ শৈব উপাসক লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগা- এই দুই গোষ্ঠীতে বিভাজিত। পদ্মের প্রভাব বেশি লিঙ্গায়েতদের মধ্যেই। কর্নাটকে ভোটারদের ১৫ শতাংশ‌ই লিঙ্গায়েত। বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিএস ইয়েদুরাপ্পা লিঙ্গায়েত গোষ্ঠীর বড় নেতা। কিন্তু ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর‌ পর থেকেই লিঙ্গায়েতরা বিজেপি থেকে দূরে সরতে থাকে। লিঙ্গায়েত ভোটে ফাটল ধরেছে বুঝতে পেরেই ভোক্কালিগাদের মন জয়ে চেষ্টা শুরু করেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। চাকরিতে মুসলমানদের ৪ শতাংশ সংরক্ষণ বাতিল করে দিয়ে লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগা গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণ চালু করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল বাসবরাজ বোম্মাইয়ের‌ সরকার।

বেঙ্গালুরুতে দলের জয়ে কংগ্রেসের মহিলা সদস্যদের উল্লাস। ফটো ক্রেডিট-পিটিআই

ভোটের ফল প্রকাশের পর এটা পরিস্কার, প্রচারে মোদীর উন্নয়নের স্লোগান থেকে মেরুকরণ- কর্নাটকে বিজেপির কাজে আসে নি কোনোটাই। তবে আঠারোর তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে সামান্য‌ই। এবার বিজেপির ঝুলিতে মোটে ৬৫ আসন। আঠারোতে ছিল ১০৪। কমেছে ৩৯টি। সেই তুলনায় পদ্মের ভোট হ্রাস পেয়েছে অল্প‌ই। আঠারোতে‌ বিজেপির ভোটের হার ছিল ৩৬.৩৫ শতাংশ। এবার কমে ৩৬ শতাংশ। কমেছে মাত্র ০.৩৫ শতাংশ। আঠারোতে‌ কংগ্রেস জিতেছিল ৮০ টি সিট। এবার ১৩৬। ৫৬টি আসন বেড়েছে হাত শিবিরের। এবারে কংগ্রেসের ভোট ৪২.৮৮ শতাংশ। আঠারোতে ছিল ৩৮.১৪ শতাংশ। কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৪.৭৪ শতাংশ। কিং মেকার হ‌ওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে এইচ ডি দেবগৌড়া পুত্র এইচডি কুমারস্বামীর‌ও। এইচডি কুমারস্বামীর দল জনতাদল ( সেকুলার)-এর জুটেছে মাত্র ১৯টি আসন। আঠারোর বিধানসভা নির্বাচনে জেডি(এস) জিতেছিল ৩৭টি আসন। কমেছে ১৮টি। পাঁচ বছর আগে জেডি ( এস) পেয়েছিল ১৮.৩ শতাংশ ভোট। এবার কমে ১৩.৩৩ শতাংশ। কুমারস্বামীর দলের ভোট কমেছে ৪.৯৭ শতাংশ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া ভোক্কালিগা গোষ্ঠীর জনপ্রিয় নেতা। বরাবর ভোক্কালিগা অধ্যুষিত এলাকাগুলি থেকেই আসন বের করে আনেন দেবগৌড়াপুত্র। কিন্তু ভোক্কালিগাদের একটি বড় অংশ যে এবার জেডি (এস) ছেড়ে হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, ভোটের ফল‌ই তার প্রমাণ। জনতাদল (সেকুলার)-এর ভোট হ্রাসের হার আর কংগ্রেসের ভোটবৃদ্ধির হার প্রায় সমান।

মনোবল ফিরল কংগ্রেসের, রসদ পেলেন রাহুল

কর্নাটকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে‌ ২৩টি আসন বেশি পেয়েছে কংগ্রেস। পাঁচ মাস আগে মোদীর গুজরাটে ভরাডুবি হলেও হিমাচল প্রদেশে বড় জয় কংগ্রেসের মুখরক্ষা করেছিল। তবে কর্নাটকে জয় বহুদিন পর কংগ্রেসকে দিল্লির এআইসিসি সদর দফতরে বিজয়োল্লাস করার সুযোগ এনে দিল। এক বছর পরে এমন দিনে হয়তো‌ লোকসভা নির্বাচনের ফল বেরিয়ে যাবে। লোকসভা নির্বাচনের আগেই রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও মিজোরামে ভোট। রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস ক্ষমতায়। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি। তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম বাদ দিলে বাকি তিন রাজ্যে লড়াইটা শুধুই কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ১৩ মে সকাল‌ থেকে রাহুল গান্ধীর ভাগ্যের চাকা সাফল্যের পথে ঘুরতে শুরু করল কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে কর্নাটক বিজয় যে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে কংগ্রেসের মনোবল ফিরিয়ে আনল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

Feature Image Credit- INC twitter.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *