অভিষেকের জনসংযোগ যাত্রা শুরু ২৪ এপ্রিল। শেষ দুই মাস পরে। তবে পঞ্চায়েত ভোট কবে? ঘোর বর্ষায় গ্রাম বাংলায় ভোট সম্ভব? পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনা কী? একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ-
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল যে চাপে আছে, অভিষেকের নব জোয়ার কর্মসূচি তার প্রমাণ। প্রথম কথা, পঞ্চায়েত ভোট কবে হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এক সময় মনে হয়েছিল, রমজান মাস পেরোলেই পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এপ্রিলের শেষে দুই মাসের কর্মসূচি নিয়ে বসে আছে শাসকদল। ‘তৃণমূলে নব জোয়ার’ কর্মসূচি উপলক্ষে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন সংযোগযাত্রা শুরু হল ২৪ এপ্রিল। শেষ হওয়ার কথা ২৪ জুন। এই দু’মাস কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ যাত্রা করবেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। অভিষেকের কর্মসূচির মূল লক্ষ্য- পঞ্চায়েত ভোটের জন্য দলকে প্রস্তুত করা। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, ‘মানুষের পঞ্চায়েত’ কর্মসূচি শেষ করে অভিষেক ঘরে না ফেরা পর্যন্ত নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করবে না কমিশন।
রাজ্য নির্বাচন কমিশন কী বস্তু, তা সবার জানা হয়ে গেছে। পঞ্চায়েতের মতো জটিল ভোট কখন করলে ভাল হয়, তা নির্ধারণে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নেই। নবান্নের ইচ্ছাই কমিশনের ইচ্ছা। অতএব নবান্ন যখন হুকুম দেবে, তখনই ভোটের ঢাকে কাঠি দেবেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি ও ভোটগ্রহণের মাঝে ন্যূনতম ২১ দিন ব্যবধান বাধ্যতামূলক। যদি একদফাতেও ভোট হয়, তবে রাজ্যে ১৬ জুলাইয়ের আগে পঞ্চায়েত নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সাধারণত জুনের ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা ঢুকে যায়। জুলাই তো ভরা বর্ষার মরশুম। অর্থাৎ ঘোর বর্ষায় রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। পঞ্চায়েত ভোট কয় দফায় হবে, তা নিয়েও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতামতের কোনও মূল্য নেই। পঞ্চায়েতে বুথের সংখ্যা ৬১ হাজার ৩৪০। তার উপর আছে ২ হাজার ‘অক্সিলিয়ারি’ বুথ। বুথ পিছু দু’জন করেও সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হলে জনবল দরকার ১ লক্ষ ২৬ হাজার ৬৮০ জন। অত পুলিশই রাজ্যের হাতে নেই। পঞ্চায়েত ভোট দফারফা করতে চাইলে কারও আপত্তিতে কান না দিয়ে একদফাতেই ভোট করবে সরকার।
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে দোলাচলে আছেন মমতা
তবে ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার দফারফা করার ফল শেষ পর্যন্ত ভাল হয় নি তৃণমূলের জন্য। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে শাসকদল যে এবার সাবধানী, তা অভিষেকের কথা থেকেই স্পষ্ট। ‘তৃণমূলের নব জোয়ার’ কর্মসূচির শুরুতেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমরাও চাই রক্তপাতহীন পঞ্চায়েত ভোট।” পঞ্চায়েত নির্বাচন আসলে শাসকদলের জন্য ‘শাঁখের করাত’ হয়ে উঠেছে। প্রতিপক্ষদের মেরে-ধরে মাঠের বাইরে দূর করে দিয়ে ম্যাচ বের করে নেওয়া তৃণমূলের জন্য কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু একে সন্ত্রাস, খুনোখুনি, রক্তপাতের কারণে সরকারের ইমেজে কালি পড়ে তার উপর পঞ্চায়েত মিটতে না মিটতেই লোকসভা নির্বাচনের হ্যাপা। তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাও স্বীকার করেন, উনিশের লোকসভা নির্বাচনে দলের খারাপ ফলের অন্যতম কারণ আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটের লাগামছাড়া সন্ত্রাস। গ্রামের মানুষ নিজের ভোটাধিকারকে ‘সিরিয়াসলি’ নেন। চোখের সামনে তা কেউ ছিনিয়ে নিলে তাঁদের আত্মাভিমানে বড় ঘা লাগে। অবাধ নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে গ্রামের মানুষ যে প্রতিশোধ নিতে ছাড়েন না, সেই শিক্ষা তৃণমূলের উনিশেই হয়ে গেছে। তাই চব্বিশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আঠারোর রিপিট টেলিকাস্ট করার আগে একশবার ভাবতে হচ্ছে শাসকদলের নেতাদের।
তৃণমূলের দ্বিতীয় সমস্যা পঞ্চায়েত নির্বাচন এমন একটা সময় করতে হচ্ছে, যখন নিয়োগ সহ নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে দল এবং সরকার কোনঠাসা। উপনির্বাচনে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সাগরদিঘি শুধু হাতছাড়াই হয় নি, দলের ভোট কমেছে বিপজ্জনক হারে। পঞ্চায়েত ভোট অবাধ করলে রেজাল্ট কী হবে, তা নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চিত নন। আবার গা জোয়ারি করলে সরকারের মান-ইজ্জত বাঁচে না। এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা নয়, পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে চাপে শাসকদলই। পঞ্চায়েত নির্বাচন ঠিক কখন করলে, সব দিক রক্ষা হয়, মনে হয় এখনও তা স্থির করে উঠতে পারেন নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই এপ্রিলের শেষেও পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামগন্ধ নেই। রাজ্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। কিন্তু নবান্ন থেকে সবুজ সংকেত আসছে না। বামফ্রন্টের আমলে জারি হওয়া পঞ্চায়েত আইনে পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করায় কমিশনের থেকে সরকারের ক্ষমতাই বেশি। একমাত্র মীরা পান্ডে ছাড়া আর কোনও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখান নি।
পঞ্চায়েত ভোট বিলম্বিত হলেই তৃণমূলের সুবিধা
পঞ্চায়েত ভোট যদি পিছোতে পিছোতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি গিয়ে পড়ে, তবে প্রাকৃতিক কারণে বড় সমস্যা হতে পারে। ঘোর বর্ষার জুলাই বাংলার জন্য খুব বিপজ্জনক মাস। বহুবার গ্রামবাংলার অনেক জনপদ জুলাই মাসে ভেসে গেছে বন্যায়। ভোটের দফা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন নিয়ে সরকার-কমিশন-বিরোধীদের টানাপোড়েনের কথাও মাথায় রাখতে হবে। টানাপোড়েনের জেরে মামলা এবং আদালতের হস্তক্ষেপের জেরে ভোটের সূচি পিছিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কী হবে? নবান্ন আদৌ জুলাইয়েও পঞ্চায়েত ভোট করতে আন্তরিকভাবে ইচ্ছুক কিনা, তা নিয়েও সংশয় আছে রাজনৈতিক মহলের। পঞ্চায়েত ভোটে হেরে যাওয়া বা খারাপ ফল করা কিম্বা ভোট ঘিরে মারামারি, খুন, সন্ত্রাস, রক্তপাতের চেয়ে ভোট বিলম্বিত হওয়াই তো তৃণমূলের জন্য মঙ্গল। পঞ্চায়েত ভোট পরে, আগে ঘর গুছিয়ে নেওয়াতেই মমতা-অভিষেকের নজর। অভিষেকের দীর্ঘ দু’মাসের জনসংযোগ যাত্রার দিকে তাকালেই তৃণমূলের কৌশলটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।