দমদম বিমানবন্দরের রানওয়েতে চলতে শুরু করা বিমানের চাকা মাটি থেকে শূন্যে না ওঠা অব্দি অনেকে সত্যিই নিশ্চিত ছিলেন না যে, কেষ্ট মন্ডল সত্যিই দিল্লি উড়াল দিলেন। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কেষ্ট সত্যিই দিল্লির পথে! দমদম বিমানবন্দর থেকে একটি বেসরকারি ফ্লাইটে অনুব্রত মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর তিন আধিকারিক। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৭ মিনিটে ফ্লাইটটি কলকাতা ছেড়ে যায়। আকাশে অনুব্রতের স্বাস্থ্যের হালহকিকত পর্যবেক্ষণ করার জন্য একজন চিকিৎসকও নিয়েছে ইডি।
এই অনুব্রত মণ্ডল ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। রাজ্য প্রশাসন বীরভূম জেলাটা অনুব্রতের নামেই যেন ইজারা লিখে দিয়েছিল। চমক-ধমক ছাড়া কথা বলতেন না। তাঁর মাথায় দিদির হাত। অতএব দিদির কেষ্টর সাত খুন মাফ! গরু পাচার মামলায় সিবিআই-ইডি অনুব্রতকে অনেক দিন ধরেই হাতে পেতে চাইছিল। কিন্তু কেষ্টর নাগালে পেতে সিবিআই-এর আধিকারিকদের কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তা সবাই দেখেছে। গরু পাচার মামলায় অনুব্রত ফেঁসেছেন। যদিও বীরভূমের বাতাসে কান পাতলেই গুঞ্জন শোনা যায়, জেলায় এমন কোনও পাচার এবং অবৈধ কারবার নেই, যার ভাগা কেষ্টর ঘরে পৌঁছায় না। কেষ্ট কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন, তা বোলপুরের মানুষ চোখের সামনেই দেখেছেন।
এককালের মৎস্য ব্যবসায়ীর দাপটে বীরভূমে বিরোধীরা মাথা তুলতে পর্যন্ত ভয় পেত। অনুব্রত মণ্ডলের ডায়ালগ সম্প্রচার করার জন্য কলকাতা থেকে বুম-ট্রাইপড হাতে বড় বড় চ্যানেলের সাংবাদিকেরা বোলপুরে ছুটে যেতেন। পদে শাসকদলের জেলা সভাপতি। অথচ চালচলনে শাহেনশা। ডিএম-এসপি বাড়িতে গিয়ে অনুব্রতকে সেলাম ঠুকে আসতেন। পুলিশকে প্রকাশ্যে বোমা মারার হুমকি দিয়েও অনুব্রত পার পেয়ে গিয়েছেন। নিজের দলের নেতাকে খুনের অভিযোগ অনুব্রতের বিরুদ্ধে। ভয় দেখিয়ে মামলা তোলা, অভিযোগকারীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া, মনোনয়ন প্রত্যাহার- এইসব ছিল কেষ্টদার কাছে জলভাত। পঞ্চায়েত নির্বাচন, পুরসভা ভোটে বীরভূম জেলায় বিরোধীদের মনোনয়নপত্রই জমা দিতে দিতেন না।
মিডিয়া কখনও অনুব্রত মণ্ডলকে উপস্থাপন করেছে বঙ্গ রাজনীতির ‘কমিক ক্যারেক্টার’ হিসেবে কখনও দোর্দন্ডপ্রতাপ একজন নেতা হিসেবে। মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে খেয়ে আর দলনেত্রীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে কেষ্ট নিজেকে বাঘ মনে করা শুরু করেছিলেন। কেষ্ট মন্ডল ভেবেছিলেন, রাজ্য প্রশাসন পাশে আছে, তাই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাবেন। তদন্তের হাত থেকে বাঁচতে আদালতে জলের মতো টাকা ঢেলেছেন। দিল্লির বাঘা বাঘা উকিলদের লাগিয়েছেন মামলা থেকে বাঁচতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনের লম্বা হাত কেষ্ট মন্ডলের কোমরে দড়ি পরিয়েছে। গরু পাচার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর সাত মাস যাবত জেলে অনুব্রত। এখন তদন্তের স্বার্থে ইডি তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে জেরা করতে চায়। দিল্লিযাত্রা এড়াতে অনেক টালবাহানা, মামলামোকদ্দমা করেছেন। কিন্তু ভবিতব্য খন্ডাতে পারেন নি। হাইকোর্টে গিয়েও ইডির তাঁকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ঠেকাতে পারেন নি অনুব্রত মণ্ডল।
বিচার প্রক্রিয়া শেষে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হবে কি হবে না, পরের কথা। কিন্তু বোলপুরের কেষ্ট মন্ডলকে বিচারের জন্য তদন্তকারী সংস্থা আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে সাধারণ মানুষের আইনের শাসনের প্রতি আস্থা, আশা-ভরসা নষ্ট হয়ে যেত। দোল পূর্ণিমার শুভদিনে অনুব্রত মণ্ডলকে টানাহ্যাঁচড়া করে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হল। শরীরে নানান অসুখ-বিসুখ। স্ত্রী গত হয়েছেন। ঘরে একমাত্র মেয়ে। খারাপ লাগছে। কিন্তু কর্মফল খন্ডাবে কে। কথায় আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। যাঁর ভরসায় কেষ্ট মন্ডল এতদিন গুচ্ছের আকাম-কুকাম করলেন , তিনি আজ তাঁকে রক্ষা করতে পারলেন? কেষ্ট মন্ডল আজ বড্ড একা। পাপের বোঝা একাই বইতে হয়।
Feature photo is representational. Photo source- Collected.