ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ চলে গেলেন। তাঁর প্রবর্তিত ওআরএস ৬ কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। মানুষটিকে একটা পদ্মশ্রী দেওয়ার কথাও কোনও দিন উত্থাপন করে নি তাঁর স্বজাতি! নীরব সাধককে শ্রদ্ধাঞ্জলি-
ওআরএস-ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন। সোজা কথায় নুন-চিনির জল। যার আরেক নাম খাবার স্যালাইন। সামান্য নুন-চিনির জল পান করিয়েই যে কলেরা বা ডায়ারিয়া আক্রান্ত রোগীকে যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়, তা প্রথম হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন একজন বাঙালি চিকিৎসক- শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ। বেঁচে থাকতে কৃতীকে ভুলে থাকা বাঙালির রোগ। শনিবার রাতে মরে গিয়ে ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ প্রমাণ করলেন- এতদিন তিনি বেঁচেই ছিলেন। প্রকৃত কাজের মানুষ আড়ালেই থাকেন এবং নীরবে নিরলস সাধনা দ্বারা জগতের কিছু উপকার করে যান। এই বাঙালি ডাক্তারবাবুটিও ছিলেন এমন ধারার একজন মানুষ। সকলের চোখের আড়ালে থেকেই ৮৮ বছর বয়সে চিরদিনের মতোই পার্থিব জগতের আড়ালে চলে গেলেন তিনি।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে ডঃ দিলীপ মহলনাবিশের জন্ম। দেশভাগের সময় ছিলেন তেরো বছরের কিশোর- পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বরাহনগরে। পরে পেশার কারণে দিলীপের বাবা পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান শ্রীরামপুরে। ১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬০-এ লন্ডন যাত্রা। সেখান থেকে ডিসিএইচ (ডিপ্লোমা ইন চাইল্ড হেলথ) করে এডিনবোরা থেকে এমআরসিপি লাভ। লন্ডনের ‘কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেনে ‘ কিছুদিন কাজ করার পর ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমেরিকায় চলে ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ।
পৃথিবী বিখ্যাত জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিকেল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এ কলেরা ও ডায়ারিয়াজনিত অসুখের ওপর গবেষণার সুযোগ পান দিলীপ। জন হপকিন্সের শাখা বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে কাজে যোগ দিতে দেশে ফিরে আসেন তিনি। কলেরা ও ডায়ারিয়া রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ শরীরের জলশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই জলশূন্যতা মোকাবিলা করার সহজ অথচ কার্যকর কোনও পদ্ধতি জানা ছিল না চিকিৎসকদের। সূচের মাধ্যমে রোগীর ধমনীতে স্যালাইন জল ঢুকিয়েই সাধারণত চিকিৎসা চলত। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারেই প্রথম নল ও সূচ বাহিত স্যালাইনের পরিবর্তে খাবার স্যালাইন বা ওআরএস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ।
কলেরা ও ডায়ারিয়া রোগের এই অব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ হাতে-কলমে প্রয়োগের প্রথম সুযোগ পেলেন একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থীদের ঢল নামল। শরণার্থী শিবিরগুলিতে বিদ্যুত বেগে কলেরা ছড়িয়ে পড়লে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ। এক কোটির বেশি শরণার্থী বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। হাজার হাজার শিশু-নারী-পুরুষ সংক্রমিত হচ্ছিল। সবার জন্য প্রচলিত স্যালাইনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছিল না চিকিৎসকদের। চটজলদি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে কলেরা রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে নুন-চিনি-সোডার ওরাল স্যালাইন চালু করে দিলেন দিলীপ। ওষুধে কাজ দিল। বহু মানুষের প্রাণ বাঁচল।
তখনও কলেরা রোগের চিকিৎসায় ওআরএস কোনও স্বীকৃত পদ্ধতি ছিল না। ঝুঁকি নিয়েই নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এই সাহসী বাঙালি ডাক্তার। একাত্তরে শরণার্থী শিবিরে ওআরএস যে ম্যাজিক দেখিয়েছিল, তার ভিত্তিতেই ডঃ দিলীপ মহলনাবিশের তৈরি করা গবেষণাপত্র জন হপকিন্সের মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। পরের বছর আসে বিশ্ববিখ্যাত গবেষণাধর্মী মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেটের‘ স্বীকৃতিও। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মেনে নেয়-‘ইন্ট্রাভেনাস ‘ স্যালাইনের পরিবর্তে ওআরএস বা খাবার স্যালাইন দিয়েও শরীরে জলশূন্যতার সহজ চিকিৎসা সম্ভব। হু-র দেওয়া তথ্য বলছে, ওআরএস প্রয়োগ করে পৃথিবীতে ৬ কোটি মানুষের অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
ডিহাইড্রেশন রোধে ওআরএসের কার্যকারিতার কথা এখন এই উপমহাদেশের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ জানেন। ওআরএস কেনার সুযোগ না থাকলে বাড়িতেই নুন-চিনির শরবত বানিয়ে রোগীকে খাইয়ে দেওয়া হয়। ডঃ দিলীপ মহলনাবিশ কখনও খ্যাতির পেছনে ছোটেন নি। যতদিন শরীর ও মন সায় দিয়েছে, নীরবে-নিভৃতেই গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন দিলীপ। প্রচার সর্বস্ব স্বজাতির ভেতরে তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। আন্তর্জাতিক স্তরে একাধিক সম্মান-স্বীকৃতি, পুরস্কার ও পদ পেয়েছেন। কিন্তু দেশ ও স্বজাতি কী দিল তাঁকে? পদ্মবিভূষণ-পদ্মভূষণ দূরের কথা, ডঃ দিলীপ মহলনাবিশকে একটা পদ্মশ্রী দেওয়ার কথাও কারও মাথায় আসল না!
Featue and other Image Source- Facebook.