ডেস্ক রিপোর্ট : বৃহস্পতিবার ডোমজুড়ে ১১ ঘন্টা জাতীয় সড়ক অবরোধ দিয়ে হাওড়ায় অশান্তির সূত্রপাত। শুক্রবার হাওড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দিনভর অবাধে চলল অবরোধ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ। আক্রান্ত অনেক পুলিশকর্মী। ভস্মীভূত বিজেপির দফতর ও একাধিক দোকান এবং বসতবাড়ি। এমনকি শনিবারও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ প্রশাসন। গুজব আটকাতে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই হাওড়া জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। হিংসা কবলিত এলাকা গুলিতে ১৪৪ ধারাও জারি করেছে পুলিশ। অশান্তি মোকাবিলায় যাবতীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে রাজ্য প্রশাসনের দাবি। কিন্তু তারপরেও শনিবার সকালে পাঁচলা থেকে গোলমালের খবর এসেছে। সেখানে দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়ে একাধিক বাড়ি ও দোকানঘর এবং একটি ক্লাবে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ঘটনার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। পুলিশ সতর্ক অবস্থায় থাকার পরেও ১৪৪ ধারা জারির মধ্যেই কীভাবে নতুন করে হাওড়ায় অশান্তির ঘটনা ঘটল-প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
বিক্ষোভ বহু রাজ্যেই কিন্তু প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা বাংলাতেই
বহিষ্কৃত বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার করা পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) সম্পর্কিত একটি মন্তব্যের জেরে গত দু’দিন ধরে দেশের অন্যান্য রাজ্যেও কমবেশি বিক্ষোভ ছড়িয়েছে। কিন্তু কোথাও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বিক্ষোভকারীরা পশ্চিমবঙ্গের মতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় নি। ঝাড়খন্ডের রাঁচিতে হিংস্র জনতাকে বাগে আনতে পুলিশ গুলি পর্যন্ত চালায়। এতে দুই দাঙ্গাকারী নিহত হয়। নূপুর শর্মাকে গ্রেফতারের দাবিতে বৃহস্পতিবার টানা এগার ঘন্টা ডোমজুড়ের অঙ্করহাটির কাছে ১১৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রেখেছিল বিক্ষোভকারীরা। নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী অবরোধ তুলে নেওয়ার আবেদন জানালেও তাতে কর্ণপাত করে নি জনতা। ব্যস্ত জাতীয় সড়কের দুই দিকে কয়েক হাজার ছোট-বড় যানবাহন দাঁড়িয়ে যায়। অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতরে অসুস্থ রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। শিশুরা খিদেয় কান্না জুড়ে দেয়। বয়স্করা গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকেন। পুলিশ অবরোধ সরাতে বিন্দুমাত্র তৎপরতা দেখায় নি বলে রাস্তায় আটকে পড়া যাত্রীদের অভিযোগ। এগার ঘন্টা পরে অবরোধ তুললে আটকে থাকা মানুষেরা ঘরে ফেরার সুযোগ পান।
মমতার ট্যুইট, শুভেন্দুর কটাক্ষ
বৃহস্পতিবার বিক্ষোভকারীদের আগ্রাসী চেহারা দেখেই রাজনৈতিক মহল আশঙ্কা করেছিল শুক্রবার বিক্ষোভের চেহারা আরও আক্রমণাত্মক হবে। প্রশাসনের কাছেও সেই রকমই খবর ছিল বলে জানা যাচ্ছে। পূর্বাভাস পাওয়ার পরেও অশান্তি ঠেকাতে পুলিশ কেন স্পর্শকাতর থানাগুলিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিল না? প্রশ্ন তুলেছ নাগরিক সমাজ। শুক্রবার দিনভর নীরব থাকলেও শনিবার সকালে ট্যুইট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন- “আগেও বলেছি, দুদিন ধরে হাওড়ার জনজীবন স্তব্ধ করে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে । এর পিছনে কিছু রাজনৈতিক দল আছে এবং তারা দাঙ্গা করাতে চায়- কিন্তু এসব বরদাস্ত করা হবে না এবং এ সবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা হবে। পাপ করল বিজেপি, কষ্ট করবে জনগণ?” বিরোধীদের প্রশ্ন- গোলমাল বাঁধিয়ে জনজীবন স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, জানার পরেও কেন দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দিলেন না মুখ্যমন্ত্রী?
শুক্রবার রাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপদ্রুত এলাকায় সেনা মোতায়েনের দাবি তুলেছিলেন রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সময় থাকতে ঘটনাস্থলগুলিতে সেনা কিম্বা কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করলে পরিস্থিতি এতটা হাতের বাইরে যেতো না বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিকে কটাক্ষ করে পাল্টা রিট্যুইট করতে দেরি করেন নি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু মুখ্যমন্ত্রীকে ট্যাগ করে শুভেন্দু লিখেছেন- “ছেড়ে দিন, কঠোর ব্যবস্থা নেবেন আপনি, কেনো মিছে ধমক দিচ্ছেন! সবে কিছু দোকানপাট লুঠেছে, পার্টি অফিস, গাড়ি পুড়িয়েছে, বোম ছুঁড়েছে, থানায় পাথর মেরেছে, রেল স্টেশন ভাঙচুর করেছে। আপনিই তো বলেন “…লাথি খেতে হয়”। বিজেপি কোনো পাপ করেনি, আপনার পাপের ফলে আজ ভুগতে হচ্ছে জনগণকে।”
দুই পুলিশকর্তা কি বলির পাঁঠা?
হাওড়ায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি ঠেকাতে পুলিশ যে ব্যর্থ এটা শেষ পর্যন্ত মেনে নিল নবান্নও। শনিবার বিকেলে হাওড়া সিটি পুলিশের সিপি সি সুধাকরকে সরিয়ে দেওয়া হল। সুধাকরের জায়গায় এলেন প্রবীণকুমার ত্রিপাঠী। কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত সিপি পদে ছিলেন প্রবীণ। হাওড়া গ্রামীণের এসপি সৌম্য রায়কে সরিয়ে দিয়েছে নবান্ন। সৌম্যের জায়গায় পাঠানো হয়েছে স্বাতী ভাঙ্গালিয়াকে। স্বাতী ছিলেন কলকাতা পুলিশের ( দক্ষিণ-পশ্চিম ) ডিসিপি। বিরোধীদের যদিও কটাক্ষ- পুলিশ আধিকারিকদের বলির পাঁঠা করা হল মাত্র। দাঙ্গায় লিপ্ত দুর্বৃত্তদের প্রতি নরম মনোভাব নিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকেই নির্দেশ ছিল বলে অভিযোগ রাজ্য বিজেপির।
হাওড়া যেতে গিয়ে গ্রেফতার সুকান্ত
এদিকে হিংসাদীর্ণ হাওড়ায় যেতে গিয়ে গ্রেফতার হলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। হাওড়ার উলুবেড়িয়া সহ একাধিক জায়গায় বিজেপির দফতর পুড়িয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। শনিবার পুড়ে যাওয়া পার্টি অফিস পরিদর্শনে উলুবেড়িয়া যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সুকান্তর। সকালে নিউটাউনের বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুখেই প্রথমে বাধা পান বিজেপির রাজ্য সভাপতি। সেই সময় বারে বারে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এমনকি সুকান্ত মজুমদারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গেও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ। পরে দুপুর সওয়া দুটো নাগাদ বাড়ি থেকে হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন সুকান্ত। কিন্তু বিজেপি রাজ্য সভাপতির গাড়ি বিদ্যাসাগর সেতুতে ওঠার আগেই আটকে দেয় পুলিশ। বাধা পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন সুকান্ত মজুমদার। টোল প্লাজার সামনে থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে লালবাজারে নিয়ে আসে পুলিশ। দলের রাজ্য সভাপতিকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখান বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা ।
Photo Sources- Collected.