শুক্রবার রাজ্যে কী ঘটতে চলেছে বৃহস্পতিবারই তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। হাওড়ার ডোমজুড়ে অঙ্করহাটির কাছে ১১৬ নম্বর জাতীয় সড়ক টানা এগার ঘন্টা অবরোধ করে রাখল উন্মত্ত জনতা। রাস্তার দুই দিকে কয়েক হাজার যানবাহন স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাসের পর বাস যাত্রী বোঝাই। ভেতরে তীব্র গরমে শিশু ও প্রবীণদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সুস্থ লোকেরাই যেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন সেখানে অসুস্থদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অ্যাম্বুলেন্স। রাস্তা ধর্মোন্মাদ জনতার দখলে। টায়ারের আগুনে আকাশ লাল। হাজার হাজার মানুষের গগনভেদী চিৎকার। সবাই এক্ষুনি নূপুর শর্মার কল্লা চায়। পুলিশ নির্বাক দর্শক। যাদের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা তাদের গলা দিয়ে বিড়ালের মতো মিউ মিউ আওয়াজ। যারা কলকাতার রাস্তায় কর্মপ্রার্থী শিক্ষিত বেকার যুবকদের অবরোধ ঝাঁপিয়ে পড়ে দশ মিনিটে তুলে দেয় সেই ম্যান ইন ইউনিফর্মরা এগার ঘন্টা প্রস্তর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ উপভোগ করল।
পুলিশ যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রী তাদের যেমন বাজায় তারা তেমনি বাজে। পশ্চিমবঙ্গে এখন এটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের উন্মত্ত অংশ রাজপথে নেমে তান্ডব চালালে, দোকান-বাজার লুট করলে, যানবাহন জ্বালিয়ে দিলে এমনকি আস্ত একটি ট্রেনে অগ্নি সংযোগ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। পুলিশের উপর তেমনই নির্দেশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের। দুধ দেওয়া গরু লাথি মারলেও ভাল- বহুদিন আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবারও যখন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থেকে শত শত নিরপরাধ মানুষ নরক যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন তখনও মুখ্যমন্ত্রী হাত জোড় করে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী জনতার কাছে অনুনয় করছেন- বাবারা শান্ত হও। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাতর আবেদনের পরেও আরও আট ঘণ্টা জাতীয় সড়ক দখল করে রেখে হাজার হাজার মানুষের হাড়-মাস মজিয়ে তবে ঘরে ফেরে বিক্ষোভকারীরা।
শাসকের ধর্ম- দুর্বৃত্তকে দমন করে নিরীহকে রক্ষা করা। শাসক যখন এর ব্যতিক্রম ঘটায় তখন রাজধর্ম ধুলোয় লুটায়। বৃহস্পতিবার বিনা বাধায় এগার ঘন্টা জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ থাকার পরেই মানুষ আঁচ করতে পেরেছিল- শুক্রবার দুপুরের পর কী ঘটতে চলেছে। দ্বিতীয় দিন শুধু অবরোধ করেই শান্ত থাকল না জনতা। ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ সব চলল। হাওড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে তুলে নিল বিক্ষোভকারীরা। বিজেপির দলীয় দফতর জ্বালিয়ে দেওয়া হল। পুলিশের গাড়ি পুড়ে ছাই। পড়ে পড়ে দুর্বৃত্ত জনগোষ্ঠীর হাতে মার খেয়ে আহত হলেন পুলিশ কর্মীরা। বহু মানুষ আক্রান্ত। উপদ্রুত এলাকার উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল রেল কর্তৃপক্ষ। যতটুকু খবর পাওয়া গেছে পরিস্থিতি তার থেকেও ভয়াবহ বলে ইঙ্গিত মিলছে। সন্ধ্যার পর থেকে হাওড়া জেলার ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করে দিয়েছে প্রশাসন।
সরকারের কাছে আমাদের এই প্রশ্ন করার সময় এসেছে- এইসব আর কতদিন? কলকাতা থেকে তসলিমা নাসরিনের বিতাড়ন হোক আর সিএএ অথবা নূপুর শর্মার মন্তব্য কিম্বা অন্য কোনও ঘটনা- যে কোনও ইস্যুতে ইচ্ছে হলেই পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসনকে স্তব্ধ করে ফেলবে একটি সম্প্রদায়ের গণদুর্বৃত্তরা? সরকার কি তাদের হাতের পুতুল? সরকার কি এদের নিয়ন্ত্রণে আনতে অপারগ? প্রশাসন কি এদের আইনের আওতায় আনতে ভীত-সন্ত্রস্ত? দয়া ভাল কিন্তু দুর্বলতা নয়। রাজধর্ম পালনে অক্ষম, ভীতু-দুর্বল সরকার কখনও শান্তিপ্রিয়, আইন মান্যকারী শিষ্ট নাগরিকবৃন্দের ভরসার স্থল হয়ে উঠতে পারে না। দুর্বৃত্তদের তান্ডব দেখে আমরা যতটা না শঙ্কিত তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত প্রশাসনের অক্ষমতা দেখে।
Photo- Collected.