মাহিন্দা রাজাপক্ষে পরিবার পরিচালিত ক্রোনি ক্যাপিটালিজম শ্রীলঙ্কা অর্থনীতি ধ্বংসের একটা বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষ প্রতিবেদন : “চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। / আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।।” কিন্তু কোনও কালেই রাজাধিরাজরা এই আপ্তবাক্য মনে রাখেন না। মাহিন্দা রাজাপক্ষেও শ্রীলঙ্কার রাজাধিরাজের থেকে কম ছিলেন না। কিন্তু আজ তাঁর প্রাসাদ জ্বলছে। জনরোষ থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে সপরিবারে নৌবাহনীর ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন মাহিন্দা। মাহিন্দা রাজাপক্ষে নিজে ভিক্ষার বাটি হাতে না নিলেও দেশের এমন অবস্থা করেছেন যে আজ ভিক্ষাও জুটছে না। ছবির মতো সাজানো এই উপমহাদেশের একমাত্র দ্বীপরাষ্ট্র আজ জ্বলছে।
রাজাপক্ষের রাজতন্ত্র!
২০০৯-এ ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে মেরে তামিল বিদ্রোহ দমন করার পর থেকেই শ্রীলঙ্কায় অসম্ভব রকমের জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। ২০০৫ থেকেই শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে জামানা চলছে। দশ বছর টানা রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৫ থেকে ১৮- মাঝে মাত্র বছর তিনেকের জন্য কলম্বোয় রাজাপক্ষে পরিবারকে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থাকতে হয়েছে। সিংহলিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে মাহিন্দা রাজাপক্ষে তাঁর গোটা পরিবারের হাতে দেশটাকে তুলে দিয়েছেন বলা যায়। শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক ব্যবস্থা ঠিক সংসদীয় নয় বরং ক্ষমতা কুক্ষিগত রাষ্ট্রপতির হাতেই। মাহিন্দার ছোটভাই গোতাবায়া শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি। ছোটভাইকে রাষ্ট্রের মাথায় বসিয়ে মাহিন্দা নিজে হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। বড়ভাই চামাল রাজাপাক্ষে সেচমন্ত্রী। আরেক ভাই বাসিল রাজাপক্ষে অর্থমন্ত্রী। ছেলে নামাল রাজাপক্ষে ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ মন্ত্রী। গোটা সরকারটাই চলত রাজাপক্ষে পরিবারের ড্রয়িংরুম থেকে।
ঢালাও চিনা ঋণের মহিমা
শ্রীলঙ্কা সরকারের ভাড়ার বৈদেশিক মুদ্রা শূন্য। মাথায় ৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের বোঝা। ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই সরকারের। নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি বন্ধ জ্বালানির অভাবে। বিদেশ থেকে জ্বালানি কেনার টাকা নেই সরকারের ঘরে। কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা স্থগিত। কারণ কাগজ কেনারও টাকা নেই সরকারের। এমনকি খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, চিনি অন্য দেশ থেকে হাত পেতে ভিক্ষা নিতে হচ্ছে। সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহীদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা সরকারকে রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা যখন গৃহযুদ্ধে জর্জরিত তখনও এমন দেউলিয়া দশায় পড়তে হয় নি দেশটিকে।
দুর্ধর্ষ এলটিটিই জঙ্গিগোষ্ঠীকে কাবু করতে চিনের সাহায্য নিতে হয়েছিল কলম্বোকে। এলটিটিই-র মোকাবিলায় সামরিক বাজেট অনেক বাড়াতে হয়। চিন থেকে অস্ত্র আসে। পিএলএ-র দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় লঙ্কান আর্মি। একসময় এলটিটিইকে চেপে ধরে একেবারে শেষ করে দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। এরপর থেকেই শ্রীলঙ্কার চিন নির্ভরতা অনেক বেড়ে যায়। শ্রীলঙ্কার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে কলম্বোকে ঢালাও ঋণ দিতে শুরু করে বেজিং। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে মাহিন্দা রাজাপক্ষে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। গৃহযুদ্ধে তামিল জঙ্গিরা বিপর্যস্ত হওয়ায় মাহিন্দা হয়ে ওঠেন সিংহলি জাতীয়তাবাদীদের নায়ক।
ভারতের সঙ্গে দূরত্ব চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব
চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। পনেরোর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে খুব অল্প ভোটে মাহিন্দার অপ্রত্যাশিত পরাজয় ঘটে। হারের জন্য ভারতের দিকে আঙুল তুলেছিল রাজাপক্ষে শিবির। ভোটে হারলেও শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে মাহিন্দা রাজাপক্ষের দাপট অক্ষতই থাকে। বছর তিনেকের মধ্যেই ফের স্বমহিমায় ফিরে আসেন মাহিন্দা। দ্বীপরাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টি রাজাপাক্ষের পরিবারিক দলে পরিণত হয়। প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ- সবকিছুর চাবিকাঠি চলে যায় মাহিন্দার আত্মীয়বর্গের হাতে। শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতিতে পারিবারিক আধিপত্য উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু অন্যদের সব রেকর্ড ম্লান করে দেয় রাজাপক্ষে পরিবার।
চিনা ঋণের ফাঁদ ও ক্রোনি ক্যাপিটালিমে ধ্বংস অর্থনীতি
দেশকে পথে বসানোর পরেও গন্ডারের মতো গোঁ ধরে ক্ষমতার চুড়ো থেকে নামতে চাইছিল না রাজাপক্ষে পরিবার। চাপের মুখে মন্ত্রিসভা থেকে একে একে পরিবারের বাকি সদস্যরা পদত্যাগ করলেও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার আঁকড়ে পড়েছিলেন মাহিন্দা। সোমবার অগ্নিগর্ভ কলম্বোয় পাঁচজনের মৃত্যুর পর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নৌঘাঁটিতে গা ঢাকা দিয়েছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এখনও রাষ্ট্রপতি পদে টিকে আছেন মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া। শ্রীলঙ্কায় এখন নৈরাজ্যের গাঢ় অন্ধকার। গোতাবায়া রাজাপাক্ষে রাষ্ট্রপতি থাকলেও প্রশাসন পরিচালনার ভার সেনাবাহিনী নিজের হাতে তুলে নিয়েছে বলে কলম্বো থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
অনেক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে গেলেও শ্রীলঙ্কা কখনও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা থেকে সরে যায় নি। কিন্তু এই বারের সঙ্কট থেকে শ্রীলঙ্কা কীভাবে বেরিয়ে আসবে তা বোঝা যাচ্ছে না। মাহিন্দা রাজাপক্ষে পরিবার পরিচালিত ক্রোনি ক্যাপিটালিজম শ্রীলঙ্কা অর্থনীতি ধ্বংসের একটা বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিজের পারিবারিক শাসনকে টিকিয়ে রাখতে চিনের হাতে দেশকে সোপর্দ করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির অভিমুখটা যদি ভারতের দিকে থাকত তাহলে এমন গাড্ডায় হয়তো পড়তে হতো না উপমহাদেশের দ্বীপরাষ্ট্রকে।
Photo- collected.