শিলিগুড়ি : বিধানসভা ভোটের ঠিক এক বছর পর দু’দিনের সফরে বাংলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শাহ সফরকে ঘিরে অনেক দিন পর ফের উজ্জীবিত দেখাচ্ছে বঙ্গ বিজেপিকে। বৃহস্পতিবার বিকেলে শিলিগুড়ির রেলওয়েজ ইনষ্টিটিউটের মাঠে রাজ্য বিজেপি আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিলেন শাহ।
বাংলায় বিজেপিকে মজবুত করায় মানুষকে ধন্যবাদ
একুশে বঙ্গজয়ের লক্ষ্য নিয়েই ভোটযুদ্ধে নেমেছিল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর পাশাপাশি অমিত শাহই ছিলেন বিজেপির প্রধান সেনাপতি । বাংলায় দলকে জেতাতে পারেন নি বহু ভোটযুদ্ধের সফল সেনাপতি অমিত শাহ। তবে তিনি যে বাংলার হাল ছাড়েন নি এদিন তার প্রমাণ রাখলেন শাহ। এক বছর পরে বাংলায় মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথম জনসভাতেই বাংলার মানুষকে ধন্যবাদ জানালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ” যখন লড়তে নেমেছিলাম তখন মাত্র তিনটি আসন ছিল। এখন আমরা ৭৭। এ জন্য বাংলার মানুষকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিজেপিকে ২ কোটি ২৮ লক্ষ ভোট দিয়ে বাংলায় দলকে মজবুত করেছেন মানুষ।”
শোধরান নি মমতা, লড়াই চালিয়ে যাবে বিজেপি
ভোটের ফলে দুঃখ পেলেও মানুষের রায়কে কটাক্ষ করা যে তাঁর ধাত নয় এদিন তারও প্রমাণ রাখলেন অমিত শাহ। শাহ বলেন,” আমরা মানুষের রায় মেনে নিয়েছি। কিন্তু মমতাদিদি শোধরান নি। আমরা ভেবেছিলাম, এবার মনে হয় দিদি শুধরে যাবেন।” একবছর পর বাংলায় ফিরে অমিত শাহর মনে হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আগের মতোই দূর্নীতিগ্রস্ত ও দমনমূলক আছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,” এক বছর পর দেখছি, বাংলায় অত্যাচার কমে নি। কাটমানি বন্ধ হয় নি। দুর্নীতি চলছেই। সিন্ডিকেটরাজ চলছেই। বিজেপি নেতাকর্মীদের খুনও বন্ধ হয় নি।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যতদিন না মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধ করবে ততদিন বিজেপি লড়াই চালিয়ে যাবে বলে হুঁশিয়ারি দেন শাহ।
করোনা চুকলেই সিএএ লাগু
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হওয়ার দুই বছর পরেও কার্যকর হওয়া থমকে আছে। এই নিয়ে অস্বস্তিতে রাজ্য বিজেপি। বিশেষ করে মতুয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। শাহ সফরে সবারই নজর বাংলায় এসে সিএএ নিয়ে কী বলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এদিন শিলিগুড়ির জনসভায় দাঁড়িয়ে অমিত শাহ বলেন,”আমি আজ পরিষ্কার বলে দিতে চাই করোনার দাপট কমলেই আমরা সিএএ জারি করব এবং আমাদের ভাইদের নাগরিকত্ব দেবো।” অমিত শাহ ভালো করেই জানেন সিএএ’র বলবৎ হওয়া ঝুলে থাকায় বাংলায় তৃণমূলের কটাক্ষ হজম করতে হচ্ছে রাজ্য বিজেপিকে। এদিন তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,” উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের কাছে পরিষ্কার বলে দিতে চাই, তৃণমূল সিএএ-র বিরোধিতা করছে। সেই কারণে তারা সিএএ নিয়ে মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছে। ওরা বলছে, সিএএ কোনও দিন বাস্তবের মাটিতে কার্যকর হবে না। কিন্তু আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই করোনার দাপট কমলেই সিএএ লাগু হবে।”
অমিত শাহ আরও বলেন,” মমতা দিদি চান অনুপ্রবেশ জারি থাকুক। এবং বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীরা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হোন। তৃণমূলের লোকেরা কান খুলে শুনে রাখুন, সিএএ বাস্তব ছিল, আছে এবং থাকবেও। মমতা দিদি আপনি কিছুই করতে পারবেন না।” সিএএ পাশ হওয়ার পর থেকেই আইনটির নীতি প্রণয়ন ঝুলে আছে। নীতি প্রণয়নের স্বাভাবিক সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও সংসদে একাধিকবার তা বাড়ানো হয়েছে। এই কারণেই বলার সুযোগ পাচ্ছে বিরোধীরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক বছর আগেও ভোটের প্রচারে এসে করোনার কারণে সিএএ-র বিধি প্রণয়ন স্থগিত আছে বলে জানিয়েছিলেন। এক বছর পরে বাংলায় এসে অমিত শাহ ফের করোনা কমলেই সিএএ বলায় ধন্ধে রাজনৈতিক মহল। তবে অনেকেই মনে করছেন, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দিয়ে নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করবে কেন্দ্রীয় সরকার।
উত্তরবঙ্গ ও পাহাড় নিয়ে ভাবে একমাত্র বিজেপি
বিধানসভা ভোটে দক্ষিণবঙ্গ বিজেপিকে বিমুখ করলেও প্রত্যাশা মিটিয়েছিল উত্তরবঙ্গ। ভোটের পরে উত্তরবঙ্গ থেকে নির্বাচিত দুই বিজেপি সাংসদ জন বার্লা ও নিশীথ প্রামাণিক পৃথক রাজ্যের দাবি তোলেন। এই নিয়ে কম জলঘোলা হয় নি। বিজেপি বরাবরই উত্তরবঙ্গের প্রতি অবহেলা নিয়ে সরব। ভোটের প্রচারে এসে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন অমিত শাহ। বছর পার করে বাংলায় এসে ফের উত্তরবঙ্গের বঞ্চনা নিয়ে সরব হলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অমিত শাহ অভিযোগ করেন, ” মমতা দিদি সবসময় উত্তরবঙ্গকে অবহেলা করেছেন। বিজেপিই উত্তরবঙ্গকে প্রকৃত মর্যাদা দিয়েছে। আগামী দিনেও দেবে।” রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন- উত্তরবঙ্গ নিয়ে কি কেন্দ্রের আলাদা কোনও পরিকল্পনা আছে? তারই কোনও ইঙ্গিত দিলেন শাহ?
দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জিতেছিল বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনেও দার্জিলিং জেলায় বিজেপির ফল একচেটিয়া। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন মমতা। জিটিএ ভোট করারও প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ির জনসভায় অমিত শাহ এই প্রসঙ্গে বলেন, “জিটিএ ভোট করে আপনি গোর্খা ভাইবোনদের কিনতে পারবেন না দিদি। এই কথাটা মনে রাখবেন।” পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ ঘন ঘন বদলায়। বিমল গুরুং, বিনয় তামাং- মোর্চার দুই গোষ্ঠীরই দাপট এখন অস্তমিত পাহাড়ে। এই পরিস্থিতিতে পাহাড় সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কেন্দ্র কোনও পদক্ষেপ করবে কিনা শাহের ভাষণে তার স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত পাওয়া গেল না বলেই মনে করছে উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক মহল।
শাহি শিক্ষায় মনোবল ফিরবে বঙ্গ বিজেপির?
বিধানসভা ভোটে হারের পর থেকেই বঙ্গ বিজেপিতে ডামাডোল। মুকুল রায় সহ আরও অনেকেই তৃণমূলে ফিরে গেছেন। বেশ কয়েকজন বিধায়ক দলত্যাগ করায় বিধানসভায় শক্তি কমেছে বিজেপির। উপনির্বাচনে দুটি জেতা আসন খোয়াতে হয়েছে। আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনেও শোচনীয় পরাজয় হয়েছে পদ্ম প্রার্থীর। পুরভোটেও বিজেপির ফল যথেষ্টই হতাশাজনক। এই পরিস্থিতিতে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত রাজ্য বিজেপির মুড চাঙ্গা করতে অমিত শাহর মতো দক্ষ সেনাপতির ভোকাল টনিক খুব দরকার ছিল বলে মনে করছেন গেরুয়া শিবিরের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা। শাহর সফরকালে বিবাদ ভুলে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন রাজ্য বিজেপির নেতারা। এখন দেখার অমিত শাহর কাছ থেকে পাঠ নিয়ে আবার আগের উদ্যম ফিরে পান কিনা বঙ্গ বিজেপির কান্ডারীরা।
Photo Credit- Bengal BJP official FB page.