পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অসহায় রাজনৈতিক প্রাণী দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। আসলে আল্লাহ ও আর্মির হেফাজতে থাকা পাকিস্তানে কোনও নির্বাচিত অসামরিক প্রধানমন্ত্রী রাখার দরকারই পড়ে না।লিখলেন উত্তম দেব-
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মতো হতভাগা দুনিয়ায় আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। লিয়াকত আলি খান ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই গুলিতে নিহত হন লিয়াকত। মহম্মদ আলি জিন্নাহর পর লিয়াকত আলি খান ছিলেন পাকিস্তানের সব থেকে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। লিয়াকতের তবু জনসভায় ঘাতকের বুলেটে সম্মানের মৃত্যু হয়েছিল। ক্যান্টমেনেন্টের জেনারেল ঘাড়ে ধরে গদি থেকে নামিয়ে দিয়েছে- এমন অপমান পাকিস্তানের ফাউন্ডার প্রাইম মিনিস্টারকে সইতে হয় নি। ইমরান খান পাকিস্তানের ২২ তম প্রধানমন্ত্রী। অনেক নাটকের পর শনিবার গভীর রাতে পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে বিদায় নিলেন ইমরান।
ইমরান গদিতে ছিলেন ৩ বছর ৯ মাস ২২ দিন। মাঠে এবং খাটে দাপট দেখানো ইমরান কেন যেচে বাঁশ নিতে রাজনীতিতে নামতে গিয়েছিলেন কে জানে। পাকিস্তানের নির্বাচিত রাষ্ট্র প্রধানদের বরাতে শেষ পর্যন্ত অপমান ছাড়া আর কিছুই জোটে না। একমাত্র নওয়াজ শরিফের মতো জাত বেহায়া ছাড়া আর কেউই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপযুক্ত নন। পদ যাওয়ার পর খান সাহেবের কপালে কী আছে জানি না। তবুও আমি বলব, ক্রিকেটের দুনিয়ায় অন্যতম সেরা এবং ক্লাসিক ফাস্ট বোলারের কপাল ভাল যে পদ খোয়ানোর মুহুর্তে পূর্বসূরিদের মতো বেইজ্জতি তাঁকে সইতে হয় নি।
জওহরলাল নেহেরুর মতোই মহম্মদ আলি জিন্নাহও ছিলেন ব্রিটিশদের ওয়েস্ট মিনিস্টারিয়াল ব্যবস্থায় মুগ্ধ। পাকিস্তানের জন্মটা যতই গোলমেলে হোক জিন্নাহ চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের দেশে শাসন ব্যবস্থা চলুক পরিষদীয় পথে। কিন্তু উপরওয়ালার মর্জিতে পাকিস্তান গেল জেনারেলদের হেফাজতে। জন্মের এগার বছরের মাথায় পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে ফৌজি। তার পর থেকে পাকিস্তানের মানুষ জানে- তাদের পাক-সাফ মুলুকটাকে চালায় উপরে আল্লাহ তো নিচে আর্মি। মাঝে সংবিধান-পার্লামেন্ট-প্রধানমন্ত্রী বলে একটা বস্তু আছে ঠিকই কিন্তু টাইম টু টাইম জেনারেলদের হাতে বলাৎকার হওয়া ছাড়া এই ত্রয়ী পাকিস্তানের রাজনীতিতে আর কী ভূমিকা রাখে তা আজ পর্যন্ত কেউই ব্যাখ্যা করে উঠতে পারলেন না।
একটা বিষয় খুব পরিস্কার- আসমানের তলে পাকিস্তান যদ্দিন জিন্দা আছে মুলুকটির মালিক উপরে আল্লাহ নিচে আর্মি। পাকিস্তানের তিন নম্বর মালিকও আছে। অনেক দিন পর্যন্ত সেই মালিকের নাম ছিল আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর। পাকিস্তানের ইতিহাসে একাধিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে আমেরিকা। অপছন্দের রেজিম চেঞ্জ ওয়াশিংটন প্রশাসনের একটি ফেভারিট গেম। পাকিস্তানের একাধিক সামরিক এবং অসামরিক শাসকের ভাগ্য নির্ধারণে আড়াল থেকে সূক্ষ্ম চাল দিয়েছে হোয়াইট হাউস। তবে এই মুহুর্তে পাকিস্তানের তিন নম্বর মালিকের জায়গায় চিন না আমেরিকা তা নিয়ে যথেষ্টই ধোঁয়াশা আছে। পাকিস্তানের জেনারেল এবং রাজনীতিবিদদের উপর আমেরিকার প্রভাব শেষ, এই কথা বলার মতো সময় এখনও আসে নি। কিন্তু চিন যে পাকিস্তানকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ইমরান খান সরকারের একাধিক পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকে খুশি করে নি। বিশেষ করে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের অবস্থান।
চিনের প্রভাবে রুশ-ইউক্রেন ইস্যুতে ইউএন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তান যেই সুরে কথা বলেছে তা আমেরিকা সহ পশ্চিমি বিশ্বের পছন্দ হয় নি। তাঁর উপরে আমেরিকা যে চাপ বাড়াচ্ছে বিদায়বেলায় একাধিকবার সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ইমরান খান। গত পরশুও খান সাহেব আক্ষেপ করে বলেছেন- ভারত নিজের মর্জিতে চলে পাকিস্তান চলতে পারে না। তখত যাওয়ার আগে ইমরানের ভারত প্রেম ছিল দেখার মতো। নওয়াজ শরিফ কন্যা মরিয়াম নওয়াজ কটাক্ষ করে বলেই ফেলেছেন- অতই যদি ভারতকে ভালবাসা তবে সেই দেশে চলে গেলেই তো পারে ইমরান।
১৯৫৮-র ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপ্রতি ইস্কান্দার মির্জার নিতম্বে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আয়ুব খান। পাকিস্তানে নিয়মতান্ত্রিক শাসনের দফারফা এবং অসামরিক রাষ্ট্রপ্রধানদের অপমানজনক প্রস্থানের সেই শুরুয়াৎ। সাতজন সিনিয়রকে টপকে জিয়াউল হককে পাকিস্তান আর্মির শীর্ষে বসিয়েছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। ভুট্টোকে ফাঁসিতে চড়িয়ে সেই ঋণ শোধ করেন জেনারেল জিয়া। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ যখন নওয়াজ শরিফ সরকারের বিরুদ্ধে ক্যু করেন তখন ফৌজিদের হাতে নওয়াজকে চড়-চটকানাও খেতে হয়েছে। মোশাররফ জামানার শেষ পর্যায়ে তৃতীয় বারের জন্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া যখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা তখন খুন হয়ে যান বেনজির ভুট্টো। বেনজিরের খুনের পেছনে পারভেজ মোশাররফের অঙ্গুলিহেলন ছিল বলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলের সন্দেহ।
পাকিস্তানে কদাপি গণতন্ত্র ও পরিষদীয় শাসনের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকার প্রধানকে সর্বদাই আর্মি জেনারেল, আর্মি ইন্টেলিজেন্স এবং বহিঃশক্তির কথায় ওঠবোস করতে হবে। তারপরেও ইসলামাবাদে পরবর্তী উজিরে আজমের কুর্শিতে বসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। পাকিস্তানের পরবর্তী হতভাগ্য প্রধানমন্ত্রী পদে কে তা জানার জন্য অপেক্ষায় আমরা।
Feature image is represantational and collected from twitter.