পুতিনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া যুদ্ধ থামানোর পথ নেই। অবশেষে মানছেন ইউক্রেনের কমেডিয়ান প্রেসিডেন্ট। জেলেনেস্কির অতিরিক্ত পুতিন বিদ্বেষ আর পশ্চিম প্রীতিই কিকাল হল ইউক্রেনের?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :যুদ্ধের পরিণতি দেখে ধীরে ধীরে কি পশ্চিমি মিত্রদের উপর ভরসা হারাচ্ছেন ভোলোদিমির জেলেনেস্কি? বৃহস্পতিবার রাতে কিয়েভে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে রাখা ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্টের বক্তব্য কিন্তু সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। বেলারুশ সীমান্তে যখন রুশ-ইউক্রেন দ্বিতীয় দফা আলোচনা চলছিল ঠিক তখনই কিয়েভে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নিজের দফতরে বসে জেলেনেস্কি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জানালেন- যুদ্ধ থামানোর তাগিদে সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলতেও তিনি আগ্রহী। ইউক্রেনে অবিলম্বে আগ্রাসন থামিয়ে তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে পুতিনকে আহ্বান জানান জেলেনেস্কি।
সাংবাদিক সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন,” এমন নয় যে আমি পুতিনের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।” ভোলোদিমির জেলেনেস্কি আরও বলেন-” আমার পুতিনের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। গোটা বিশ্বেরই পুতিনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আলোচনা ছাড়া যুদ্ধ থামানোর আর কোনও পথ নেই।” রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আটদিনে পড়েছে। পুতিনের সমর কৌশলটা ঠিক কী তা এখনও বুঝে উঠতে ব্যর্থ আন্তর্জাতিক মহল। তবে গোটা ইউক্রেন ইতিমধ্যেই রুশ হামলায় বিধ্বস্ত। ইউক্রেনের ভূখন্ডে বিপুল সংখ্যক স্থলসেনা ঢুকিয়ে দিয়েও ধীরেসুস্থে অগ্রসর হচ্ছে রাশিয়া। এদিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের সামরিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে মস্কো। রাজধানী কিয়েভের পাশাপাশি খারকিভ, ওডেসা, মারিউপোল সহ ইউক্রেনের একাধিক বড় শহর রুশ হামলায় লন্ডভন্ড।
অবিলম্বে রাশিয়াকে না থামালে দেশের কী অবস্থা হতে পারে এটা বুঝেই যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সুর নরম করেছেন বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। জেলেনেস্কির এত বিলম্বিত বোধোদয় কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, পশ্চিমি মিত্রদের উপর বেশি ভরসা করে ঠকেছেন ইউক্রেনের কমেডিয়ান রাষ্ট্রপ্রধান। জেলেনেস্কির প্রথম ভুল- তিনি ভেবেছিলেন মুখে হম্বিতম্বি করলেও ন্যাটোর ভয়ে শেষ পর্যন্ত সামরিক অভিযান থেকে বিরত থাকবেন পুতিন। রাশিয়া যখন সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করল, তখন জেলেনেস্কি ভেবেছিলেন, ইউক্রেনকে বাঁচাতে আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো এখনও পর্যন্ত যে ভূমিকা নিয়েছে তাতে যে তিনি সন্তুষ্ট নন তা জেলেনেস্কির কথাতেই স্পষ্ট।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিম ইউরোপের একাধিক দেশ ইউক্রেনকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও চাপিয়েছে আমেরিকা ও তার সহযোগীরা। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন জো বাইডেন। বৃহস্পতিবারের সাংবাদিক সম্মেলনে আরও একবার ইউক্রেনের আকাশকে “নো ফ্লাই জোন” বা উড়ান নিষিদ্ধ অঞ্চল ঘোষণা করতে ন্যাটোর কাছে আবেদন জানিয়েছেন ভোলোদিমির জেলেনেস্কি। ইউক্রেনের এই আবেদন আগে একবার খারিজ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। বাইডেন প্রশাসনের আশঙ্কা, এই ধরণের যে কোনও পদক্ষেপ রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে দেবে আমেরিকাকে। জেলেনেস্কি পশ্চিমি মিত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, “যদি ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করা সম্ভবই না হয় তবে আমাদের আরও বেশি সংখ্যায় যুদ্ধবিমান দিয়ে সাহায্য করো।”
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের এই কথার মধ্যে হতাশার সুর খুঁজে পাচ্ছেন সমর বিশেষজ্ঞরা। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে জেলেনেস্কি খানিকটা নার্ভাস বলেই মনে করছেন তাঁরা। কিয়েভে নিজের দফতরে বসে বৃহস্পতিবার জেলেনেস্কি রাশিয়ার মতিগতি সম্পর্কে পশ্চিম ইউরোপের বন্ধুদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন-“ভগবান না করুন, যদি আমরা তারপরেও বাঁচতে না পারি; ল্যাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া হবে পুতিনের পরবর্তী শিকার।” ইউক্রেনের মতোই এই তিনটি বল্কান রাষ্ট্রও ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন এরা প্রত্যেকেই ন্যাটোর সদস্য। পুতিনকে ইউক্রেনেই থামাতে না পারলে রাশিয়া তার মানচিত্রকে আবার আগের জায়গায় নিয়ে যাবে- এই ভয় দেখিয়ে জেলেনেস্কি তাঁর পশ্চিমি মিত্রদের স্নায়ুর চাপে ফেলতে চাইছেন বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা।
রাশিয়ার কূটনীতিকদের দাবি- সঙ্কটের সূত্রপাত থেকেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে বিশ্বাসী ছিলেন তারা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের একরোখা মনোভাবের কারণেই আলোচনার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে বলে রাশিয়ার অভিযোগ। জেলেনেস্কির অতিরিক্ত পুতিন বিদ্বেষ আর পশ্চিম প্রীতিই কি কাল হল ইউক্রেনের?