ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা বিমুখ হয়ে যাচ্ছে । স্কুলে যেতে, ক্লাস করতে, পরীক্ষা দিতে তাদের আর ভাল লাগছে না। স্কুল বন্ধ। রাজ্যের অধিকাংশ সরকার পোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুলে অনলাইন ক্লাসের অবস্থাও তথৈবচ। পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য পরীক্ষায় পাশ নয় শেখা। না শিখেও পাশ করে যাওয়ার এই আদতকে আদর দিয়ে লালন করার পরিণাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? লিখলেন উত্তম দেব –
পরীক্ষা দেবো না । এমনিই পাশ করিয়ে দিতে হবে ! এখন এই দাবিতেও অবরোধ-আন্দোলন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। টেস্ট পরীক্ষা বাতিল করতে হবে । বাইশের মাধ্যমিকেও সবাইকে পাশ করিয়ে দিতে হবে – এই দাবিতে শুক্রবার দুপুরে জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র কদমতলা অবরোধ করে ক্লাস টেনের ছাত্রছাত্রীরা। জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের ( মাধ্যমিক ) দফতরে গিয়ে পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়ে আসে পড়ুয়ারা । স্কুল ইউনিফর্ম পরে বিনা পরীক্ষায় মাধ্যমিক পাশের দাবিতে রাস্তায় নামছে ছাত্রছাত্রীরা – এই দৃশ্য যত বেমানানই হোক এখন এটাই ঘোর বাস্তব । পরীক্ষা না দিয়েই স্কোরশিটে নব্বুই শতাংশ নম্বর দেখতে পাওয়ার মধ্যে আর কোনও গ্ল্যানি নেই পনের-ষোল বছরের বাচ্চাদের। জলপাইগুড়ি শহরের এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা পরীক্ষায় পাশের দাবিতে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে , যেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন অভিভাবকেরা। বেশিদিন আগেরও কথা নয় সে’সব ।
স্কুলে যাওয়া । ক্লাসরুমে বসে পড়ালেখা করা । স্যার-ম্যামদের মুখোমুখি বসে পাঠ নেওয়া। পরীক্ষায় বসা। পরীক্ষা দেওয়ার অভ্যেসটাই অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর নষ্ট হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদেরা । ২০২০-র মার্চের মাঝামাঝি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ। এক বছর নয় মাস হয়ে গেছে , এখনও সেই অর্থে ক্লাসরুমে ফিরতেই পারে নি পড়ুয়ারা। কবে ফিরবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশিকা পরীক্ষায় – বিশে দু’একটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল , একুশে বিনা মূল্যায়নেই সবাইকে পাশ । বাইশে মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেক সরল করে পরীক্ষা দুটি নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বোর্ডগুলি। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ছাড়বে কেন । যখন চোখের সামনেই দেখেছে পরীক্ষা না দিয়েও নাইন্টি পার্সেন্ট নম্বর পাওয়া যায় তখন পরীক্ষায় বসার ঝামেলায় তারা যাবে কেন। ছাত্রছাত্রীরা এখন আর কিছু জানতে চায় না। পড়তে চায় না। পরীক্ষা দিয়ে নিজের জানাকে যাচাই করতে চায় না। তারা শুধু পাশ করতে চায় । অনেক নম্বর নিয়ে পাশ করতে চায় । এই মানসিকতা একদিনে আসে নি। কোভিড অতিমারি এক ধাক্কায় মানসিকতাটাকে অনেক জোরালো করেছে মাত্র। অতিমারির আগে ছাত্র-ছাত্রীরা না পড়েই পরীক্ষায় বিশাল নম্বর আশা করত। অতিমারির পরে পরীক্ষা না দিয়েই ভাল রেজাল্ট আশা করছে তারা। এইটুকুই যা পার্থক্য।
এই মানসিকতার জন্য দায়ী কি শুধু বাচ্চারা ? যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বোর্ডের পরীক্ষাগুলির খাতা দেখেন তাঁরা ভালই জানেন তাঁদের কাছে কী ধরণের নির্দেশিকা উপর থেকে আসে। গণতন্ত্রের সবথেকে বড় দুর্বলতা হল , এখানে সবসময় শাসককে জনমন জয়ে উদগ্রীব থাকতে হয় । জনগণ কীসে খুশি , এটাই সরকারের মাথাব্যথা । মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের মতো প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলিতে যদি কেজি দরে নম্বর বিলিয়ে দিলেই জনগণ সন্তুষ্ট হয় তবে সেই সহজ রাস্তা ছাড়ার মতো আহাম্মকি দেখাতে রাজি নয় সরকার। গণতন্ত্রে ভোটের চেয়ে বড় পরীক্ষা আর কী আছে। সেই পরীক্ষায় পাশের জন্য সব পরীক্ষাকে লঘু করে দেওয়া যায়।
এটা ঠিক যে, পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য পরীক্ষা দেওয়া নয় শেখা, জানা । দক্ষতা তৈরি করা । তা সেই শেখা-জানাটা কতটুকু এগোচ্ছে ? কোভিডকালে ক্লাসের বিকল্প অনলাইন ক্লাস । এক বছর নয় মাস যাবৎ স্কুল বন্ধ। রাজ্যের সরকার পোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে অনলাইন ক্লাসের হালহকিকত নিয়ে শিক্ষা দফতর,শিক্ষামন্ত্রী যথেষ্টই ওয়াকিবহাল,এমন ধারণায় উপনীত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। উপর মহল বিষয়টিতে যত্ন নিলে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের অভিযোগ করার জায়গা থাকত না । বাস্তব সত্য এটাই যে, কমপক্ষে নব্বুই শতাংশ সরকার পোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুলে কার্যত পড়ালেখা লাটে উঠে গেছে। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির লক্ষ লক্ষ পড়ুয়াকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা সহজ ব্যাপার নয় জানা কথাই। অজস্র দরিদ্র অভিভাবকের একটি অ্যান্ড্রয়েড হ্যান্ডসেট কেনার সামর্থ্য নেই । মাসে মাসে নেট প্যাকের খরচ দেওয়াও কষ্টকর অনেকের পক্ষে। কিন্তু কীভাবে ক্লাসের সকল ছেলেমেয়েকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা যায় সেই পদ্ধতি উদ্ভাবনে কখনও আন্তরিকভাবে ভেবেছে শিক্ষা দফতর ? স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটিগুলি কখনও ভেবেছে কিছু একটা উপায় বের করা যায় কিনা ? মাস্টারমশাই-দিদিমনিরা হৃদয় দিয়ে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছেন ? ছাত্রছাত্রীরা তো তাঁদের সন্তানতুল্য। বিরাট সংখ্যায় একটা প্রজন্ম যে গোল্লায় যেতে বসেছে , মানুষ গড়ার কারিগরদের হৃয়কে তা ব্যথিত করছে কি ?
এই যে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা বিমুখ হয়ে যাচ্ছে । পরীক্ষা বিমুখ হয়ে পড়ছে । না পড়েই মোটা নম্বর চাচ্ছে । সেই ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে সরকার। এর শেষ কোথায় ? মানুষই হচ্ছে একমাত্র প্রাণী,প্রকৃতি যাকে মেধা ছাড়া আর কোনও স্কিল দেয় নি। মেধা হচ্ছে এমন একটি যোগ্যতা যা দিয়ে সমস্ত দক্ষতা অর্জন করা যায়। মানুষ করেছেও তাই। মেধার উৎকর্ষতা বিকাশের সময় এবং স্থানকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় যেভাবে পচিয়ে ফেলা হচ্ছে তার মূল্য গুণে গুণে শোধ দিতে হবে আমাদের।
Photos- Reporter.
কনটেন্টটি পড়ে আপনার ভাল লাগলে পোর্টালটির উন্নয়নে আপনি সাহায্য করতে পারেন donate now অপশনে ক্লিক করে-