রাজ্য বিজেপির সভাপতি বলছেন,দুম করে ভোট ডেকে দেওয়ায় বিজেপি প্রস্তুত নয়। বিজেপিকে প্রস্তুত করার দায় কি প্রতিপক্ষ তৃণমূলের ? যারা নিজের মুখেই মেনে নিচ্ছে তারা প্রস্তুত নন,সেই দলকে কেন ভোট দিতে যাবে জনগণ ? লিখলেন উত্তম দেব-
আগামী ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা পুরসভার ভোট । মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। পয়লা ডিসেম্বর শেষ দিন । তৃণমূল এমনকি বামেদেরও প্রার্থীতালিকা প্রকাশিত হয়ে গেছে। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপি তাকিয়ে আছে আদালতের দিকে , হাইকোর্ট সোমবার কী রায় দেয় এই অপেক্ষায়। একসঙ্গে সবকটি পুরসভায় ভোট না করানো নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। মামলা চলাকালীনই আইনের ফাঁক বুঝে আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে পুরভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। এখন আদালত কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। তাই বলে একটা রাজনৈতিক দল, তাও আবার প্রধান বিরোধীদল আদালতের রায় না বেরোনো পর্যন্ত হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে! অথচ গতবছর নির্ধারিত সময়ে কলকাতা সহ অন্যান্য পুরসভায় ভোট গ্রহণের কথা শুরু হতেই বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব তেড়েফুঁড়ে পুরভোটের লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন। অতিমারির কারণে পুরভোট স্থগিত হয়ে যায় । তারপর হুগলি নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। অমিত শাহের মতো দুঁদে রাজনীতিক পর্যন্ত ধরে নিয়েছিলেন যে,একুশে হেসেখেলে দুশো পার করে বাংলার মসনদ দখল করবে বিজেপি। কিন্তু ২ মে ইভিএম খোলার পর দেখা গেল বিজেপি কুল্যে মাত্র সাতাত্তর। সেই যে রাজ্য বিজেপিতে শনির দশা লাগল ছয়মাস পরেও তা লাঘব হওয়া তো দূরের কথা উল্টে শনিদেব যেন পাকাপাকি ভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন ৬,মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া বাড়িটির ওপর । নইলে যেই দলটা রাজ্যের প্রধান এবং একমাত্র বিরোধীদল । যেই দলটা হারলেও ঝুলিতে ৩৮.১৩ শতাংশ ভোট । সেই দলটা এইভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে ?
কলকাতা বাংলার রাজধানী। কলকাতা পুর কর্পোরেশন ক্ষমতার একটা অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সেই কলকাতা পুর কর্পোরেশনের ভোটের দিনক্ষণ ঘোষিত হয়েছে । অথচ বিজেপির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা তৃণমূলকে ওয়াকওভার দিয়ে বসে আছে। ভেতরের খবর প্রার্থী তালিকা নিয়ে প্রাথমিক কাজটুকুও শুরু করে উঠতে পারে নি বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব। আগামী বুধবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। সোমবারও ১৪৪ আসনে বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে কিনা সন্দেহ । কটি আসনে দল প্রার্থী দেবে তা নিয়েও নাকি ধন্ধে রয়েছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। যেই দলটা সাতমাস আগেও ধরেই নিয়েছিল নবান্ন তাদের করতলগত হয়ে গেছে , সেই দলটা একটা হারের চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখছে ! হেস্টিংস আর ৬, মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া দুর্গের ভেতরের অবস্থা যদি সত্যিই এই হয় তবে বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলার শুকিয়ে যাওয়া পদ্ম সরোবরে আবার কবে ফুল ফুটবে স্বয়ং ভগবানের পক্ষেও সেই ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব।
বাম জামানার প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্য বিজেপির সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে আশাতীত সাফল্যের পর ভাড়াটে সেনা আর হাওয়ায় ভর করে বাংলায় কামিয়াব হওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল বিজেপি । পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন , জনভিত্তি এবং পরিষদীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতা – কোনওটাই আগে তেমন ছিল না। আজকে হঠাৎ করে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদলে পরিণত হয়ে পদে পদে সেই অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তৃণমূল থেকে আসা ভাড়াটে সেনারা লাইন ধরে তৃণমূলে ফিরে যাচ্ছেন । টলিপাড়ার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মুখ ফেরাচ্ছেন । বাবুল সুপ্রিয়র মতো মোদীজির খাতিরের মানুষও ভাগলবা। এদিকে পুরো দলটা উপর থেকে নিচ অন্তর্দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। এখনও ঘর সামলেই উঠতে পারলেন না রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। টাকাপয়সার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গন্ডগোল আর নারীঘটিত দোষে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি গোল্লায় গেছে বলে প্রকাশ্যেই তোপ দেগেছেন বর্ষীয়ান নেতা তথাগত রায়। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী একা মাঠে লড়ে যাচ্ছেন। তৃণমূল ছুট শুভেন্দুর নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ আছে তাই প্রাণপণে লড়ছেন। কিন্তু ভোটের আগে প্রতিদিনই সভা-সমাবেশ আর সাংবাদিক সম্মেলনে রণংদেহী হুঙ্কার ছাড়তেন বিজেপির যে বীরপুরুষেরা , তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবথেকে বড় প্রশ্ন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি বাংলা বিজেপিকে ইতিমধ্যেই খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে ? যেমন ভাবে বাম জমানায় রাজনৈতিক স্বার্থে প্রদেশ কংগ্রেসকে বলি দিত কংগ্রেস হাইকমান্ড । বাংলায় বিজেপিকে উজ্জীবিত করার চাইতে মোদি-শাহর কাছে এখন অনেক বেশি জরুরি চব্বিশে দিল্লির মসনদ ধরে রাখা। তার জন্য দিদিকে ম্যানেজ করতে হলে তাতেও পিছপা হবে না বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। দিদিকে ম্যানেজ করার জন্য দিদির রাজ্যে দলের পায়ে বেড়ি পরাতে হলে পরাবে দীনদয়াল ভবন। এই ধরণের পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো দিল্লিতে বসে তাদের আঞ্চলিক নেতাদের আঙুলের ইশারায় নাচায় । প্রদেশ কংগ্রেসের নেতাদের এই অভিজ্ঞতা আছে।
নিজেদের সুযোগ-সুবিধা মতো তাদের চুলার আঁচ বাড়াতে-কমাতেই পারে রাজনৈতিক দলগুলি। আঁচে সাধারণ কর্মীরা পুড়ে মরতেই পারে। কিন্তু জনগণের মন চির চঞ্চল। পাবলিকের দিতে যেযন বাধে না তেমনি নিতেও । দুই মে’র পর পশ্চিমবঙ্গে পাঁচটি উপনির্বাচন হয়েছে। তিনটিতে জামানত পর্যন্ত খুইয়েছেন বিজেপির প্রার্থীরা । শান্তিপুরের মতো শক্ত ঘাঁটিতে মাত্র ছয়মাসের ব্যবধানে ২৬.৭২ শতাংশ ভোট হারিয়েছে বিজেপি, যার বড় অংশ ফিরে গেছে বামেদের ঘরে। সামনেই পুরভোট । আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যেই ধাপে ধাপে রাজ্যের সবগুলো পুরসভার ভোট সেরে ফেলা হবে বলে আদালতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। হাইকোর্ট বাগড়া না দিলে আগামী ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা পুরসভার ভোট হচ্ছেই । রাজ্য বিজেপির সভাপতি বলছেন , ” সরকার দুম করে ভোট ডেকে দেওয়ায় আমরা প্রস্তুত হওয়ার সময় পাই নি। ” ভোটের জন্য বিজেপিকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার দায় কি তৃণমূলের ? যারা ভোটে লড়ার জন্য প্রস্তুতই নন তাদের ভোট দিতে যাবে কেন জনগণ ।
File Photos.
To read this content in Hindi also click on Select Language option.