সংসদে ভারি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একের পর এক ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকায় কৃষি আইন যে বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে,এই হিসেব গুলিয়ে গিয়েছিল বিজেপির পাকা মাথাদেরও। কৃষি আইন নিয়ে সরকারের আত্মসমর্পণ প্রমাণ করল, আধুনিক ভারত শিল্পে যতই উন্নতি করুক না কেন আজও ভারতকে চালায় কৃষি ও কৃষক । লিখলেন অরুণকুমার –
সাড়ে সাত বছরের শাসনে দ্বিতীয় আর কোনও ইস্যুতে এতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নি নরেন্দ্র মোদীকে। যাকে বলে নাকে খত দিয়ে পিছু হটা, শেষ পর্যন্ত তাই করতে বাধ্য হল কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করার এক বছর ৫২ দিনের মাথায় তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার দিনটি ছিল গুরুনানকদেবের জয়ন্তী । গরজ বড় বালাই । গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল গুলির কাছে ভোটের চেয়ে বড় গরজ আর কী থাকতে পারে। শিয়রে একাধিক রাজ্যে ভোট । বিজেপির জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন । পাঞ্জাব-হরিয়ানার পর কৃষি আইনের সবথেকে বেশি বিরোধিতা এসেছে ওয়েস্টার্ন ইউপির জাঠ অধ্যুষিত এলাকা থেকে । কৃষি আইন নিয়ে জেদাজেদি করে বিজেপির সবথেকে বেশি রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে পাঞ্জাবে। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত জোটসঙ্গী শিরোমনি অকালি দলকে হারিয়েছে বিজেপি , যার জেরে পাঞ্জাবে গেরুয়া ব্রিগেডের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কার্যত অন্ধকার হয়ে পড়েছিল । ২০১৭-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের পেছনে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ সম্প্রদায়ের বড় ভূমিকা ছিল । মোদী সরকারের তিন কৃষি আইনের জেরে জাঠ বেল্টে পদ্ম যে পায়ের নিচে যথেষ্টই জমি হারিয়ে ফেলেছে এই গোপন রিপোর্ট বহু আগেই দিল্লির দীনদয়াল ভবনে পৌঁছে গিয়েছিল। কৃষকদের ক্ষতে প্রলেপ না পড়লে বাইশে যোগীর পক্ষে লখনৌর মসনদে ফেরা যে প্রায় না মুমকিন , এটা বিলম্বে হলেও ঠাহর করতে পেরেছেন মোদী-শাহ । বাইশে উত্তরপ্রদেশে যোগী না ফিরলে চব্বিশে কাঁটায় কাঁটায় ভরে যাবে মোদীর সাউথ ব্লকে ফেরার পথ। ক্ষমতা না থাকলে জেদ ধুয়ে কি শাসক জল খায় ? অতএব জেদকে শতদ্রুর জলে বিসর্জন দিয়ে এক বছর দুই মাস পরে কৃষি আইন লাটে তুলে দেওয়াই শ্রেয় মনে করলেন প্রধানমন্ত্রী।
নোটবন্দীর মতো বিপজ্জনক খেলা হেলায় উতরে গেছেন নরেন্দ্র মোদী। জিএসটি নিয়ে কারও বিরোধিতায় কর্ণপাত করে নি কেন্দ্রীয় সরকার। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও এটার রাজনৈতিক প্রতিষেধক বিজেপির হাতে মজুত ছিল । কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ যখন তুঙ্গে , নরেন্দ্র মোদীকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল । কিন্তু মোদীর চরম বিরোধীও মানবেন, অক্সিজেন ও ভ্যাকসিন সরবরাহের সঙ্কট দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে কেন্দ্র। নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে সাম্প্রতিক সময়ে সবথেকে বেশি বেগ দিচ্ছে জ্বালানির লাগামছাড়া বৃদ্ধি । ইউপির ভোটের দিন যত এগিয়ে আসবে জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে তত বেশি তাগিদ অনুভব করবে কেন্দ্রীয় সরকার এবং দাম কমানোর কলাকৌশল সরকারের জানা আছে। কিন্তু কেন্দ্রের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিল তিন কৃষি আইন। জিএসটি থেকে বিলগ্নিকরণ – গত সাড়ে সাত বছরে বিরোধীদের শত বিরোধিতাও সরকারকে লক্ষ্য থেকে টলাতে পারে নি। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিধি প্রণয়ন ঝুলিয়ে রাখলেও আইনটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বিজেপির সামনে। এইভাবে একের পর এক ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকায় কৃষি আইন যে বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে , এই হিসেব গুলিয়ে গিয়েছিল বিজেপির পাকা মাথাদেরও । মোদীর ভাষণে অনুশোচনার সুর স্পষ্ট। কৃষি আইন নিয়ে জনগণের দাবির কাছে সরকারের আত্মসমর্পণ প্রমাণ করল , আধুনিক ভারত শিল্পে যতই উন্নতি করল আজও ভারতকে চালায় কৃষি ও কৃষক ।
তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে এক বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে কৃষকেরা । আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি পাঞ্জাবের কৃষক সম্প্রদায় । যাদের সিংহভাগ শিখ সর্দারজি । এরপরেই ছিল হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ সম্প্রদায়ের চাষীরা । আন্দোলনে মদত এসেছ মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের বড় কৃষকদের কাছ থেকেও । কিন্তু মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন কেবল পাঞ্জাব , হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা । এই তিন রাজ্যের কৃষকেরা ভারতের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র টলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ভারতের কৃষিক্ষেত্র বিশাল এবং তার সমস্যা গুলিও ছোট নয় । কৃষি ব্যবস্থায় সংস্কার নিশ্চয় দরকার। কিন্তু তা কীভাবে ? প্রশ্ন এখানেই । কৃষিক্ষেত্রে সঙ্কট নিরসনে কী করা উচিত , তা নিয়ে কৃষক সংগঠন ও সরকারের মধ্যে মতভেদ আছে । তিন কৃষি আইনে কর্পোরেটদের সুবিধা দিতে গিয়ে কৃষকদের স্বার্থ অবহেলা করা হয়েছে – এই ছিল আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলির অভিযোগ । তাই শুধু কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণাতেই খুশি হচ্ছেন না আন্দোলনকারীরা । কৃষকেরা সরকারের কাছে চাইছেন, কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বৃদ্ধি সহ আরও একাধিক রক্ষাকবচ।
ভারতে আইন প্রণয়নের মতো আইন প্রত্যাহারের বিষয়টিও বেশ জটিল। তিন আইনের প্রত্যাহার চেয়ে সংসদে বিল আনতে হবে সরকারকে । সংসদের দুই কক্ষে বিল গৃহীত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিলেই আইন তিনটি বাতিল হবে। কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণাকে বিজেপির রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবেই দেখছে বিরোধীরা । আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল । কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সাত বছরের জামানায় এই প্রথমবার বিজেপিকে কোনঠাসা দেখাচ্ছে। এই সাত বছরে দিল্লি , পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে বিজেপিকে অপ্রত্যাশিত পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। কিন্তু সেসবও জাতীয় পর্যায়ে বিজেপিকে খুব একটা অস্বস্তিতে ফেলতে পারে নি । কিন্তু লাগাতার কৃষক আন্দোলনের মুখে কৃষি আইন প্রত্যাহার করার পর বিজেপিকে এখন ভাবতে হচ্ছে , এরপর কোন রণকৌশল নিলে দলের ভাঁটা পড়া জনপ্রিয়তায় ফের জোয়ার আনা যায় । কৃষি আইন নিয়ে বাড়াবাড়ির পরিণামে যে রাজনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে , মোদী-শাহ তা পুষিয়ে উঠতে পারেন কিনা এখন এটাই দেখার।
ফটো – অরুণকুমার।