দেবীবাড়ির বড়দেবী : কাহিনীতে ভরপুর কোচবিহারের রাজাদের রাজসিক পুজো - nagariknewz.com

দেবীবাড়ির বড়দেবী : কাহিনীতে ভরপুর কোচবিহারের রাজাদের রাজসিক পুজো


কোচবিহারের রাজ পরিবারে মা দুর্গা পূজিতা বড়দেবী নামে। ৫১১ বছরের এই প্রাচীন পুজোর পরতে পরতে রোমহর্ষক কাহিনী আর জনশ্রুতি । মহারাজারা নেই। পুজো আছে।‌ পুজোর মধ্যেই বেঁচে আছে কোচ রাজাদের কত স্মৃতি। লিখেছেন অরুণকুমার

কোচবিহার রাজ পরিবারের দুর্গাপুজোর পরতে পরতে নানা  অলৌকিকতা, গা ছমছমে রহস্য-রোমাঞ্চ, বিচিত্র সব আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি আর অজস্র কাহিনী-উপকাহিনীর ছড়াছড়ি। এক‌ই কোচ রাজবংশ থেকে দুটি দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল ষোড়শ শতকের প্রথম দশকে। কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম মহারাজ বিশ্ব সিংহ। কোচবিহারের রাজ পরিবারের নামে দেবীবাড়ি মন্দিরে বড়দেবীর ( কোচবিহার রাজবাড়ির দুর্গা এই নামেই পূজিতা) যে পুজো হয়ে আসছে তার সূত্রপাত মহারাজ বিশ্ব সিংহের হাত দিয়েই। ”চিকনা” নামে‌ অহম রাজ্যের এক গভীর জঙ্গলে অলৌকিকভাবে এই পুজোর সুচনা হয়েছিল ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে। বিশ্ব সিংহের অনুজ শিষ্য সিংহ। তিনি বৈকুন্ঠপুরের রায়কত রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের নামে ৫১২ বছর ধরে যে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে তার গোড়াপত্তন করেছিলেন মহারাজা শিষ্য সিংহ‌ই। কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি- পাশাপাশি দুই শহরের দুই রাজ‌ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো বাংলার প্রাচীন দুর্গোৎসব গুলির মধ্যে অন্যতম। 

কোচবিহারের দেবীবাড়ি : যেখানে পুজো হয় বড়দেবীর।

মহারাজ বিশ্ব সিংহের মাধ্যমে কোচ রাজবংশে দুর্গাপুজোর সূচনাটা বেশ অলৌকিক।‌ কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা তখন নিতান্তই কিশোর।  তিনভাই শিষ্য-চন্দন-মদন এবং অন্যান্য খেলার সাথীদের নিয়ে অহম রাজ্যের চিকনায় গভীর জঙ্গলে ভ্রমণ করার সময় একটি “ময়না গাছের” ডালকেই দেবী দুর্গা রূপে কল্পনা করে বনের ফুল-ফল দিয়ে পুজো দেন বিশ্ব সিংহ।‌ মাকে তুষ্ট করতে বলি দরকার। কিন্তু গভীর জঙ্গলে পাঁঠা পাবেন ক‌ই। ভাই শিষ্য সিংহ সঙ্গীদের একজনকেই পাঁঠা সাজিয়ে বেঁধে ফেলেন। বিশ্ব সিংহ খেলাচ্ছলে কুশ দিয়ে বন্ধুর ধরে আঘাত করতেই অলৌকিকভাবে মুন্ডু ধর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বন্ধুর কর্তিত মস্তক গভীর জঙ্গলে দেবী দুর্গার নামে উৎসর্গ করেন মহারাজ। জনশ্রুতি যে চিকনার জঙ্গলে সেই অলৌকিক ঘটনার পর থেকেই দেবীর বর লাভ করেন বিশ্ব সিংহ। তাঁকে দেখা দিয়ে স্বয়ং নিজ হাতে কঙ্কন ও তীক্ষ্ণ খড়্গ প্রদান করেন আদ্যা শক্তি মহামায়া। দেবী ‌দুর্গার বরে বলীয়ান হয়ে চিকনার অধিপতি তুরকা কোতোয়ালকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে কোচবিহারের সিংহাসনে আসীন হন মহারাজ বিশ্ব সিংহ। প্রতিষ্ঠা করেন কোচ রাজবংশের। অর্থাৎ কোচ রাজবংশের উদ্ভবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন দেবী দুর্গা।

ময়নাকাঠের কাঠামোর উপর তৈরী হয় বড়দেবীর প্রতিমা।

চিকনার জঙ্গলে বিশ্ব সিংহ দ্বারা দেবী দুর্গার পুজো ১৫১০ সালের ঘটনা বলেই মনে করছেন গবেষকেরা। ময়না গাছের ডালকেই মা দুর্গা রূপে কল্পনা করেছিলেন কোচবিহার অধিপতি। তাই আজ‌ও বড়দেবীর প্রতিমা নির্মাণে ময়না গাছের ডাল অপরিহার্য। কাঁটাযুক্ত এই গাছ হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের জলা জমিতে জন্মায়। আজ‌ও  ময়না গাছের সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন পুজোর আয়োজকেরা। পছন্দ মতো গাছ পেলেই তার ডাল কেটে এনে শ্রাবণ মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে আসা হয়  কোচবিহারের গুঞ্জবাড়ির ডাঙ্গরাই মন্দিরে। এগারো ফুট লম্বা কাঠটিকে নববস্ত্র পরানোর পর পুজো করেন পুরোহিত। এই সময় পায়রা বলি দেওয়ার‌ও চল আছে। ময়নাকাঠের সামনে পরমান্ন ভোগ দেওয়া হয়। কোচবিহার রাজ পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে ময়নাকাঠকে নিমন্ত্রণ জানাতে সন্ধ্যায় ডাঙ্গরাই মন্দিরে উপস্থিত হন ”দুয়ারবক্সী”। বাজনা বাজিয়ে পালকিতে চড়িয়ে ময়না কাঠকে নিয়ে তিনি র‌ওনা হন মদনমোহন বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানে এক মাস‌ ধরে যুগচ্ছেদন পুজো চলে ময়না কাঠের। ময়নাকাঠের উপরেই দন্ডায়মান থাকেন বড়দেবীর মৃন্ময় প্রতিমা। তাই কাঠটিকে বলা হয় শক্তিদন্ড ।রাধাষ্টমী তিথিতে সূর্যোদয়ের পূর্বেই  শক্তিদন্ডকে নিয়ে আসা হয় বড়দেবীর মন্দির দেবীবাড়িতে। এখানে পাটে ( পাটাতনে ) স্থাপন করা হয় এগার ফুটের কাষ্ঠদন্ডটি। এই প্রথাকে বলা হয় দেবীর শক্তিগোজ স্থাপন। এরপর  শক্তিদন্ডের গা থেকে কাপড় খুলে নেওয়া হয়। এই অবস্থায় তিনদিন থাকে ময়নাকাঠটি। এই রীতিটির নাম “হাওয়া খাওয়ানো”। “হাওয়া খাওয়ানো” শেষ হলে শুরু হয় কাঠের উপর দেবী প্রতিমা নির্মাণের কাজ। মায়ের মুখের মাটি আসে আসে কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার চামটা গ্রামে কোচ রাজাদের দান করা নির্দিষ্ট জমি  থেকে।‌

বড়দেবীর যে মূর্তিটি আজ আমরা দর্শন করে ধন্য হ‌ই তা কোচ রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা মহারাজ নরনারায়ণকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন‌ বলে জানা যায়। এর পেছনেও আছে বিরাট এক কাহিনী। মহারাজ নরনারায়ণের ভাই অপ্রতিরোধ্য বীর চিলা রায়ের কথা কে না জানে। একবার অগ্রজকে বধ করে সিংহাসন দখলের দুর্মতি হয়েছিল চিলা রায়ের। দাদা নরনারায়ণকে হত্যার অভিপ্রায় নিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হলে চিলা রায় দেখতে পান স্বয়ং দেবী দুর্গা দশহাত দিয়ে মহারাজকে আগলে রেখেছেন। এই দৃশ্য দেখে ভয়ে শুকিয়ে যায় বীর চিলা রায়ের আত্মা। তিনি দাদার পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মহারাজ নরনারায়ণ আদরের ভাইকে ক্ষমা করেন। কিন্তু মহারাজের মনে দুঃখ চাগিয়ে ওঠে এই‌ ভেবে যে ছোটভাই ভাগ্যবান, তাই স্বচক্ষে দেবীর দর্শন পেয়েছে। মায়ের দর্শন থেকে বঞ্চিত হ‌ওয়ায় নিজেকে ধিক্কার দেন মহারাজ নরনারায়ণ।‌ দুঃখে অন্ন-জল পর্যন্ত  ত্যাগ করে বসলেন তিনি।  তিনদিন পর স্বপ্নে ভক্ত নরনারায়ণের কাছে ধরা দিলেন জগজ্জননী।‌ স্বপ্নে ঠিক যেই রূপে মা ধরা দিয়েছিলেন ঠিক সেই রূপেই মায়ের প্রতিমা নির্মাণ করার  নির্দেশ দিলেন মহারাজ নরনারায়ণ। শারদীয়া দুর্গাপুজোয় আজ‌ও সেই প্রতিমাই বড়দেবী রূপে দেবীবাড়ি মন্দিরে চারদিন ধরে সাড়ম্বরে পূজিতা হন।

বড়দেবীর প্রতিমা , যা স্বপ্নে দেখেছিলেন মহারাজ নরনারায়ণ।

কোচবিহার রাজ পরিবারে পূজিতা বড়দেবীর প্রতিমার সঙ্গে অন্যত্র পূজিতা দুর্গা প্রতিমার পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। বড়দেবীর গাত্রবর্ণ টকটকে লাল। অসুর দলনী দেবীর চোখ বিস্ফোরিত। অসুরের গায়ের রঙ গাঢ় সবুজ। দেবীর দক্ষিণ পার্শ্বে শ্বেতবর্ণ সিংহ অসুরের পা কামড়ে ধরেছে। বাম পার্শ্বে  অসুরের হাতে কামড় বসিয়েছে ব্যাঘ্র।  এখানে মায়ের সঙ্গে তাঁর চার পুত্রকন্যাকে দেখা যায় না। দেবীর দুই পাশে অবস্থান করেন সখী জয়া আর বিজয়া। এক সময় এই পুজো করতেন কোচবিহারের মহারাজারা। রাজ্যপাট কবেই চলে গেছে কালের গর্ভে। কিন্তু আজ‌ও রাজার পুজো রাজার নামেই হয়। এক সময় পুজো পরিচালনা করত রাজ পরিবার। এখন পুজোর দায়িত্বে রয়েছে কোচবিহার রাজ পরিবারের দেবোত্তর ট্রাস্ট। বড়দেবীর পুজো ঘিরে রয়েছে অনেক মিথ,রহস্য আর লোকশ্রুতি। একসময় কোচবিহারের রাজাদের এই পুজোয় নরবলির চল ছিল। কোচ রাজবংশের দ্বিতীয় নৃপতি মহারাজ নরনারায়ণ এই নরবলির প্রচলন করেছিলেন বলে জানা যায়। মহাষ্টমী ও নবমীর সন্ধিলগ্নে অত্যন্ত সংগোপনে নরবলি অনুষ্ঠিত হত। কোচবিহারের ঊনবিংশতম রাজা মহারাজ নরেন্দ্র নারায়ণ ভূপ ( ১৮৪৭-১৮৬৩ ) এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করে দেন। অর্থাৎ কোচবিহারের রাজাদের পুজোয় দীর্ঘদিন নরবলি চালু ছিল।

নরবলি বন্ধ হলেও দেবীর তুষ্টিসাধনে কয়েক ফোঁটা নররক্ত দেওয়ার প্রথা প্রতীকিভাবে হলেও এখনও চালু। মহাষ্টমী ও নবমীর সন্ধিলগ্নে বড়দেবীর ”গুপ্তপূজা” যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। এই  সময়  পুরোহিত ও রাজ পরিবারের সদস্য ব্যতীত অন্যদের পুজোস্থলে প্রবেশ নিষেধ। ”কামসানাইট ” উপাধিধারী এক ব্যক্তি নিজের আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেবীর পায়ে নিবেদন করেন।‌ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পুতুল‌ও দেবীর সামনে বলি দেওয়া হয়। বাইরে তখন প্রবল আওয়াজে বাজতে থাকে ঢাক। রাজাদের পুজো রাজসিক হ‌ওয়াই স্বাভাবিক। দেবীকে আমিষ ভোগ নিবেদনে কোন‌ও বাধা নেই। বড়দেবীর পুজোয় নবমী তিথিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দেবীকে মূল অন্নভোগ নিবেদন করা হয় নবমীতেই। পাঁচটি পাঁঠা ও একটি পানি মাছ বলি দিয়ে দেবীর ষোড়শপচার পুজো সমাপনের পর আসে অন্নভোগ নিবেদনের পালা। বোয়াল মাছ সহযোগে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে।

বড়দেবীর প্রতিমা , যা অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার থেকে অনেকটাই আলাদা।

বড়দেবীর প্রতিমা বিসর্জন পর্ব সেরে ফেলা হয় দশমীর সকালেই। পুজো শেষে দেবীবাড়ি থেকে প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা র‌ওনা হয় যমুনা দিঘিতে। যমুনা দিঘি রাজ পরিবারের নিজস্ব দিঘি। বিসর্জনের পূর্বে ঘাটেও একটি নিয়ম পালিত হয়। একে বলে “হালুয়া পূজা”। দেবী পুজোর কটাদিন যে রাজকর্মচারীরা ফুলের যোগান দিয়ে থাকেন তাদের বলা হয় হালুয়া। বিসর্জনের ঘাটে হালুয়ারা শাপলার চালের ভাত রেঁধে দেবীকে ভোগ নিবেদন করেন। এরপর ঘাটে একটি শূকর‌ও বলি দেওয়া হয়। হালুয়া পূজা শেষে প্রতিমা খন্ড খন্ড করে দিঘীতে বিসর্জন দেওয়াই নিয়ম। কোচবিহার রাজ পরিবারের কোনও সদস্য দেবীর বিসর্জন পর্ব দেখতে পারেন না। বড়দেবীর প্রতিমা বিসর্জন না হ‌ওয়া পর্যন্ত কোচবিহার শহরের অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন বন্ধ থাকে।

কোচবিহার রাজাদের প্রাসাদ।

কোচবিহারে যতদিন রাজাদের রাজত্ব ছিল, ততদিন মহাষ্টমীর দিন রাজ্য জুড়ে মহোৎসব পড়ে যেত। এইদিন মহারাজ প্রজাদের দর্শন দিতেন। বছরে একটি মাত্র দিন‌ই মহারাজার দর্শন পেত  প্রজারা। মহাষ্টমীর সকালে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে হাতির পিঠে চড়ে বিশাল শোভাযাত্রা সহযোগে দেবীবাড়িতে পদার্পণ করতেন মহারাজ। দেবীকে পুজো ও অঞ্জলি প্রদান শেষে মন্দির প্রাঙ্গণে এনে রাখা  রাজসিংহাসনে উপবেশন করতেন তিনি। সামনে হাজার হাজার প্রজা। মুখোমুখি বসে প্রজাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন কোচবিহারের মহারাজারা। বিজয়া দশমীর বিকেলে প্রাসাদের মাঠে এসে পাট হাতির পিঠে চড়ে আকাশে খঞ্জন পাখি ছেড়ে দিতেন মহারাজ। খঞ্জন পাখি যে দিকে উড়ে যেত পুজো শেষে সেই দিকেই রাজ্যজয়ে অভিযানে বেরোতেন কোচবিহারের রাজারা। এবং বড়দেবীর আশীর্বাদে যথারীতি বিজয়ী হয়েই ফিরতেন তাঁরা। খঞ্জন পাখি ছেড়ে দেওয়ার পর একটি কুমড়ো বলি দিতেন রাজার প্রতিনিধি দুয়ারবক্সী। ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল কোচবিহারের শেষ স্বাধীন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুরের মৃত্যুর সাথে সাথেই এই প্রথা চিরদিনের মতো লোপ পায়।

তথ্য ও ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন যাঁরা –

  • ডঃ নৃপেন্দ্রনাথ পাল, লেখক ও গবেষক
  • জয়ন্তকুমার চক্রবর্তী, হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট,দেবোত্তর ট্রাস্ট,মদনমোহন মন্দির,কোচবিহার
  • চন্দ্রশেখর রায়


















Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *