” ডিউটি টু ফ্যামিলিকে ডিউটি টু কান্ট্রির কাছে বলি দিতে পারব ” – প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
তাঁর মাত্র একুশ বছরের জীবন যেন একটি মহাকাব্যিক উপাখ্যান। আজকের দিনে বাঙালি ঘরের ক’জন আধুনিকা তাঁর নাম জানে জানি না। কিন্তু তাঁকে না জানলে , তাঁকে না বুঝলে আজকের বাঙালি নারী জানবে কেমন করে আজ থেকে ৮৮ বছর আগে তাদেরই এক পূর্বনারী নির্ভীকতা , দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের কোন সর্বোচ্চস্তরে নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯৩২ এর আজকের দিনেই আত্মবলিদান দিয়েছিলেন বিপ্লবী প্রীতিলতা। ১৯৩২ এর ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব তছনছ করে দেওয়ার পর মুখে পটাসিয়াম সায়ানাইড ঢেলে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর চার মাস আঠারো দিন !
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে সবথেকে সুসংগঠিতভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্তম্ভে সবথেকে জোরালো আঘাতটি যদি কেউ হেনে থাকেন তবে তাঁর নাম মাষ্টারদা সূর্যসেন । তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ ও অন্তরের আগুন ছিল সূর্যকিরণের মতোই প্রখর । চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে যে যুবগোষ্ঠীকে মাষ্টারদা স্নেহ-মমতা-শাসন এবং দেশপ্রেমের আদর্শে সংগঠিত করেছিলেন তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় । শুধু ছেলে নয় দেশমাতৃকার চরণে তিনি নৈবেদ্য দিয়েছিলেন মেয়েদেরও । এখানেও মাষ্টারদা অনন্য । বিপ্লবী আন্দোলনে শান্তি ঘোষ , সুনীতি চৌধুরী এবং বীনা দাশগুপ্তের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথায় রেখেও বলতে হয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র ধারায় নারীর এত নিবিড় অংশগ্রহণ বিপ্লবী সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির আগে আর কেউ করে দেখাতে পারে নি। অন্তরালে থেকে শুধু পুরুষবিপ্লবীদের সহায়তা নয় একেবারে ফোরফ্রন্টে থেকে গেরিলা অ্যাকশানে নেমেছিলেন মাষ্টারদার হাতে গড়া দুই বিপ্লবী নারী কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার ধলঘাট গ্রামের বৈদ্য পরিবারের মেয়ে প্রীতিলতা। বংশের প্রকৃত উপাধি দাশগুপ্ত। বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার কাজ করতেন স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল অফিসের করণিক পদে । মা প্রতিভা দেবী ব্যস্ত থাকতেন গৃহকর্মে । সাধারণ বাঙালি পরিবার। ছয় ভাইবোনের সংসারে প্রীতিলতা দ্বিতীয়। মা আদর করে ডাকতেন রানী । লাজুক এবং অন্তর্মুখী । কিন্তু ভেতরে ছিল বিদ্রোহের বারুদ আর দেশপ্রেমের আগুন । আবার প্রচন্ড মেধাবিনীও । ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভীষণ ভাল । ১৯২৮এ ম্যাট্রিকুলেশনে একাধিক বিষয়ে লেটার মার্কস সহ ফার্স্ট ডিভিশন । ১৯৩০এ ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম ।১৯৩২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ডিসটিংশান সহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও প্রীতিলতা ও বীনা দাশগুপ্ত – এই দুই বিপ্লবী নারীর রেজাল্ট ও সার্টিফিকেট ইংরেজ সরকারের নির্দেশে আটকে দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । ২০১২তে দু’জনকেই মরণোত্তর ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শৈশব থেকেই প্রীতিলতার হৃদয়ে দেশপ্রেমের উন্মেষ । ঢাকায় আইএ পড়ার সময়ই বাংলার অন্যতম নারী স্বাধীনতাসংগ্রামী লীলা নাগের ( রায় ) সংস্পর্শে আসেন তিনি। আর কলকাতার কলেজজীবন থেকেই বিপ্লবের আগুনে আত্মাহুতি দেওয়ার লক্ষ্যে নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে ফেলেন প্রীতিলতা। লাজুক বাঙালি কন্যা । হালকা পাতলা শ্যামলা গড়ন । শান্ত দুটি চোখ। বাপমায়ের আদরের রানী । বাড়ির উঠোন ঝাঁট দেওয়া থেকে মায়ের সঙ্গে বাসন মাজা সংসারের সব কাজেই পারদর্শী। অথচ ঘরের এই শান্ত শিষ্ট লক্ষ্মীমেয়েই ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে কখন আসবে দেশের ডাক কখন আসবে দেশের ডাক। ১৯৩০ এর ১৮ই এপ্রিল রাতে মাষ্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক যুব বিদ্রোহে সামিল হতে পারেন নি বলে মনে আক্ষেপ ছিল খুব।
১৯৩০ এর ২রা ডিসেম্বর চাঁদপুর স্টেশনে বাংলা পুলিশের আইজিপি টিজে ক্রেগের বদলে ভুল করে এসডিও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করলেন মাষ্টারদার দুই বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তী। আদালতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে মৃত্যুদন্ড আর কালীপদ চক্রবর্তীকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা দিলেন বিচারক । ১৯৩১ এর ৪ঠা আগষ্ট ভোরে কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির আগে ছদ্ম পরিচয়ে জেলে গিয়ে রামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রায় চল্লিশবার সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
নিঃশঙ্ক চিত্ত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের বীরের মৃত্যুবরণ বিপ্লবী জীবনের দিকে প্রীতিলতার অভিযাত্রাকে আরও দ্রুততর করল । তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন সংসার নয় দেশমাতৃকার কাজে সমরাঙ্গনে মৃত্যু বরণেই তাঁর জীবনের প্রার্থিত সার্থকতা। এই বীরাঙ্গনার নিজের ভাষায় – ” তাঁর গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদীমন এবং প্রগাঢ় উপলব্ধিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।রামকৃষ্ণদার ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।”
কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে সংসারের হাল ধরতে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন বটে কিন্তু মনে অস্থিরতা কখন মাষ্টারদার সঙ্গে দেখা হবে , কখন মাষ্টারদা দলে টেনে নেবেন । চট্টগ্রামের ধলাঘাটে এক গোপন আস্তানায় অবশেষে নিজের বিপ্লবী গুরুর দেখা পেলেন প্রীতিলতা । রানীকে প্রথম দেখাতেই বিপ্লবের অগ্নিপুরুষের যা মনে হয়েছিল – ” দেখলাম তাঁর মধ্যে অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই। মনে হল, একজন ভক্তিমতী হিন্দুর মেয়ে হাতে প্রদীপ নিয়ে আরতি দেবার জন্য দেবতার মন্দিরে ভক্তি ভরে এসে দাঁড়িয়েছে “
দলনেতার কাছে প্রীতিলতা প্রার্থনা করেছিলেন , অ্যাকশন । নেতাও বুঝেছিলেন , কন্যারূপী এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জন্মই দেশমাতার চরণতলে আত্মোৎসর্গের জন্য। চট্টগ্রাম পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব । ক্লাবের দরজায় লেখা ” কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ ” । এই অপমানের বদলা নিতে ইউরোপিয়ান ক্লাবটিই গুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মাষ্টারদা সূর্যসেন। অভিযানের দিন ঠিক হল ১৯৩২ এর তেইশে সেপ্টেম্বর। প্রীতিলতার নেতৃত্বেই দশজনের স্কোয়াড ক্লাব আক্রমণ করবে বলে ঠিক করে দিলেন মাষ্টারদা। সংগঠনের সর্বাধিনায়ককে প্রীতিলতা বললেন, ” আমি কিন্তু আর ফিরব না দাদা। এক জনকে তো জীবন দিয়েই শুরু করতে হবে। মানুষ মনে করে, মেয়েরা অক্ষম, মেয়েরা দুর্বল। ভ্রান্ত এই ধারণা ছিন্ন করার সময় এসেছে। তা হলেই আমার বিশ্বাস, বাংলার বোনেরা দুর্বলতা ত্যাগ করবে, হাজারে হাজারে যোগ দেবে বিপ্লবী সংগ্রামে।”
স্বয়ং নিজের হাতে পাঞ্জাবি পুরুষের বেশে তাঁর প্রীতিকে , তাঁর প্রাণের প্রতিমাকে সাজিয়ে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে ছিলেন মাষ্টারদা। প্রীতিলতার শহিদের মৃত্যু বরণের পর মাষ্টারদার স্মৃতিচারণ পড়ে আজও চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে পাঠকের। মাষ্টারদা লিখেছেন, ” সাজিয়ে দিয়ে যখন করুণভাবে বললাম, তোকে এই শেষ সাজিয়ে দিলাম। তোর দাদা তো তোকে জীবনে আর কোনোদিন সাজাবে না, তখন প্রতিমা একটু হেসেছিল। কী করুণ সে হাসিটুকু! “
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা ৪৫ মিনিট নাগাদ পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবে তিনটি দলে ভাগ হয়ে হামলা চালান বিপ্লবীরা। ক্লাবে তখন চল্লিশজন ইংরেজ নারীপুরুষ আমোদউল্লাসে ব্যস্ত । প্রীতিলতা হুইসেল বাজাতেই শুরু হয় আক্রমণ । বোমা গুলির শব্দে মুহুর্মুহু কেঁপে ওঠে ইংরেজদের আমোদাগার । অন্ধকার নেমে আসে ক্লাবে । ইংরেজ অফিসারেরা কোমড় থেকে রিভলবার খুলে প্রতিআক্রমণ শুরু করলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দেহের বাম পাশে বুলেট ছুঁয়ে যায় । সেই আঘাত তেমন গুরুতর কিছু ছিল না। কিন্তু ফিরবে বলে তো আসে নি অগ্নিকন্যা । দলের বাকি সদস্যদের দ্রুত ফিরে যেতে বলে নিজে গলায় ঢাললেন পটাসিয়াম সায়ানাইড । পরদিন ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সশস্ত্র বিপ্লবের যে ধারা তার বেদীমূলে নারী হিসেবে আপন প্রাণ প্রথম বলি চড়িয়েছেন বাঙালি প্রীতিলতাই । সেদিন পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে এক শ্বেতাঙ্গ নারীর মৃত্যু হয়েছিল এবং আহত হয়েছিল এগারো জন ইউরোপিয় নারীপুরুষ ।
আত্মাহুতির পূর্বরাতে গর্ভধারিনী জননীর কাছে শেষ চিঠি লিখল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় রানী – ” মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো—তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মোছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না।” অবমানিতা স্বদেশজননীর চোখের জল মোছাতে গর্ভজননীর কোল খালি করে মহাকালের কোলে স্বেচ্ছায় চিরআশ্রয় নিয়েছিলেন মাত্র একুশ উত্তীর্ণ এক বাঙালি ললনা।
বিপ্লবের কন্টকাকীর্ণ পথে নামানোর আগে প্রীতিলতাকে একটু বাজিয়ে নিতেই মাষ্টারদার সতীর্থ নির্মল সেন প্রশ্ন করেছিলেন – পরিবারের প্রতি টান কেমন তোমার ? প্রীতিলতা উত্তর দিয়েছিলেন – “টান আছে। কিন্তু ডিউটি টু ফ্যামিলিকে ডিউটি টু কান্ট্রির কাছে বলি দিতে পারব”। দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত হয়েই যেন ধরায় এসেছিলেন বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ।
Pictures – Archives.