কংগ্রেস আর তৃণমূলের দোস্তি একটি আসন্ন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা । তাগিদটা কংগ্রেসেরই বেশি । তেমন ঘটলে বাংলায় বামেরা পড়বে জলে । তারা কি একলা চলবে ? নাকি মমতার বদান্যতায় একটি-দুটি আসন পেয়ে বিজেপি বিরোধী জোটে নাম লেখাবে বামেরা ? একটি রাজনৈতিক পর্যালোচনা –
কংগ্রেস আর তৃণমূল যে অনেকটাই কাছাকছি এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । দুটি দলকে শীঘ্রই হাত ধরাধরি করতেও দেখব আমরা । রাজনীতিতে ধরাধরি হোক আর ছাড়াছাড়ি – সবই পরিস্থিতির খেলা মাত্র । আসলে দুই হাজার চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস ও তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা একটি অনিবার্য রাজনৈতিক বিক্রিয়া । সোনিয়া এবং মমতা – কার মনে কী আছে জানেন একমাত্র দু’জন আর জানেন অন্তর্যামী ভগবান । লোকে বাইরে থেকে শুধু অনুমান করতে পারে মাত্র । ২মের নজরকাড়া সাফল্যের পর জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তৃণমূলের উৎসাহ যে তুঙ্গে থাকবে তা জানা কথাই । উৎসাহের আতিশয্যে তৃণমূলের লোকেরা মমতাকে মোদীর বিকল্প ও বিজেপি বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী মুখ বানিয়ে ফেলেছেন প্রায় । ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা কোন নেতার না থাকে । কিন্তু তকদির ক’জনকে সুযোগটি দেয় । বহু জাতীয় নেতার এই খোয়াইশ পূর্ণ হয় নি । আবার কপালে লেখা ছিল বলে অনেকে না চাইতেই দেশের সবথেকে ওজনদার পদটি পেয়ে গেছেন ।
নিকট অতীতে তৃণমূল দলটা জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে খুব একটা সদ্ব্যবহার করে নি । এগারোয় জোট বেঁধে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে থাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । রাজ্যে শরিক কংগ্রেসকে দুর্বল করার পাশাপাশি দিল্লিতে সোনিয়া-রাহুল-মনমোহনকে পদে পদে বিড়ম্বনায় ফেলতে যা যা করণীয় তার সব কিছুই করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো । শেষে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মাঝামাঝি সময়ে মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভা থেকে সরে যায় শরিক তৃণমূল । মমতার নির্দেশে দলের ছয় মন্ত্রী পদত্যাগ করেন । তারপর থেকে সোনিয়া-রাহুল খুশি হওয়ার মতো কোনও কাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন বলে ট্র্যাকরেকর্ড নেই ।
কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি বিরোধী কোনও জোট গড়ার অর্থই হল চব্বিশের যুদ্ধে মোদী-শাহকে ওয়াকওভার দেওয়া । আবার কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে বিজেপি বিরোধী কোনও মহাজোটের প্রধানমন্ত্রী মুখ হবেন কংগ্রেসের বাইরের মুখ এটাও অলীক কল্পনা মাত্র । ১৯৮৯ সালের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের কোন ও সদস্যের বসার সৌভাগ্য হয় নি । ২০০৪ এ পরিবারের বউ সোনিয়া গান্ধীর যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত তখন বিদেশিনী ইস্যু তুলে তাতে জল ঢেলে দেয় বিজেপি । পুত্র রাহুল দুই হাজার চারেই রাজনীতিতে এলেও রাহুলের রাজনৈতিক সাবালকত্ব নিয়ে সংশয় আছে খোদ কংগ্রেসের নেতাদেরই । ২০১৯ এ মোদীর বিপরীতে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী প্রোজেক্ট করেই ভোটে লড়েছিল কংগ্রেস । স্বাধীনতার পর জাতীয় কংগ্রেসের জন্য সবথেকে খারাপ সময়ের শুরু নিঃসন্দেহে ২০১৪য় । যদিও শুরুর শুরুটা হয়েছিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের জমানাতেই । ২০১৪ থেকে ২১ – এই সাত বছরে দেশে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অগ্রগতি দূরে থাকুক অবস্থা আরও ছন্নছাড়া হয়েছে । উনিশে দলের শোচনীয় পরাজয়ের ধাক্কা রাহুলকে প্রায় রাজনীতি বিমুখ বিবাগী করে তুলেছিল । এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়েছেন বলে মালুম হচ্ছে । তা মোদী জমানায় কংগ্রেসের হাল যতটাই খারাপ হোক কংগ্রেসই এখনও বিজেপি বিরোধী একমাত্র জাতীয় দল ।
২০১৪য় প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর থেকে মোদী ম্যাজিক যদি সবথেকে ফিকে কখনও হয়ে থাকে তবে তা এখন । বিশে করোনা প্যান্ডেমিক দিয়ে মোদীর দুঃসময়ের শুরুয়াৎ । একুশে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এতটাই বেকায়দায় যে চব্বিশে দিল্লির মসনদ দখলের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে শুরু করে দিয়েছে বিরোধীরা । অসমে প্রত্যাবর্তন ঘটলেও বিপুল আশা জাগিয়েও বাংলায় শোচনীয় পরাজয় যে জাতীয় স্তরে বিজেপিকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । স্বাভাবিক ভাবেই এই কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের । ২ মের পর থেকে সঙ্গত কারণেই জাতীয় রাজনীতিতে মমতার ঔজ্জ্বল্য বহুগুণ বেড়ে গেছে । কিন্তু বিরাট জয়ের প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি এক জিনিস আর বহু দলের বিরোধী জোটের মধ্যমণি হয়ে রাতারাতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ হয়ে যাওয়া আরেক জিনিস । দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার একটাই কিন্তু বিরোধী শিবিরে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার অনেক । খাতায়কলমে তৃণমূল জাতীয় দল বটে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তার প্রাসঙ্গিকতা কতখানি তা সবাই জানে। ট্যুইটারে হ্যাস ট্যাগ মেরে মেরেই তৃণমূল রাজমহল পর্বতমালার ওই পাশে যে বিস্তীর্ণ ভারতবর্ষ আছে তা রাতারাতি দখল করে ফেলবে রাজনীতি তেমন ম্যাজিকই নয় । পশ্চিমবঙ্গে বেয়াল্লিশে বেয়াল্লিশ পেয়েও দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাজি ধরা দিবাস্বপ্ন মাত্র।
রাহুল গান্ধীর সামনে নিঃসন্দেহে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন ‘ হয় এবার নয় নেভার ‘ গোছের একটা রাজনৈতিক যুদ্ধ হতে চলেছে । মা হিসেবে সোনিয়াও চাইবেন চব্বিশে ছেলের যেন কপাল ফিরে এবং ছেলে যেন বংশের মুখ উজ্জ্বল করার একটা সুযোগ পায় । আব কি বার দিদি সরকার বলে তৃণমূল যতই তড়পাক , ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর ভালোই জানেন , রাজনীতিতে কত ধানে কত চাল হয় । খোয়াব ছেড়ে সোনিয়া-রাহুলের সঙ্গে দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলতেই যে তিনি মমতা-অভিষেককে পরামর্শ দিয়ে চলেছেন তা রাজনৈতিক মহলের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না । নিঃসন্দেহে সোনিয়া-রাহুলকেও একই শলা দিচ্ছেন প্রশান্ত কিশোর। জাতীয় স্তরে কংগ্রেস ও তৃণমূল কাছাকাছি আসতেই বাংলায় প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের বুলি পাল্টে যাবে । সেই লক্ষণ ইতিমধ্যেই ইতিউতি প্রকাশিত । অধীর চৌধুরীর মতো কট্টর মমতা বিরোধীও সাংবাদিকেরা তৃণমূলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই মোলায়েম সুরে জবাব দিচ্ছেন। বিধানসভায় দল সাকুল্যে ২.৩ শতাংশ ভোট পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে সোনিয়া-রাহুলের আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে ? লোকসভায় তৃণমূল দুটো আসন ছাড়লেই খুশিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুর্নিশ করবে কংগ্রেস হাইকমান্ড ।
কিন্তু বামেদের কী হবে ? চব্বিশকে পাখির চোখ করে কংগ্রেস ও তৃণমূল যদি আমে-দুধে মিশ খেয়ে যায় তবে সিপিএমের কী হবে ? বাংলায় জোটের কী হবে ? বিমান বসুর একটি মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে মিডিয়া । বিজেপি বিরোধী যে কোনও মোর্চায় বামেদের হ্যাঁ ছাড়া না নাই – এমনটাই নাকি বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতার বক্তব্য। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বামেদের প্রভাব এখন এতটাই নগণ্য যে মিত্র বামেদের কথা ভাবাই বন্ধ করে দিয়েছে কংগ্রেস হাইকমান্ড । কিন্তু কংগ্রেসকে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কী রাজনৈতিক অবস্থান নেবে সিপিএম ? শেষ পর্যন্ত বিজেপি বিরোধী কোনও মহাজোট দানা বাঁধবে কিনা তা সময়ই বলবে । তবে সেই মহাজোটে বামেরা সামিল হলে পশ্চিমবঙ্গে মমতা কি দয়া দেখিয়ে একটি-দুটি আসন ছাড়বেন সিপিএমকে ?
Photo Credit – The Asian Age , PTI. Cover pic is file and symbolic only .