আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী গুটিয়ে নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন । আমেরিকা আফগানিস্তান ছাড়ছে । কিন্তু তুলে দিয়ে যাচ্ছে কাদের হাতে ? দু’দশক আগে যাদের তাড়াতে আফগানিস্তানে অভিযানে নেমেছিল আমেরিকান বাহিনী আজ তাদের হাতেই দেশটাকে তুলে দিয়ে যাচ্ছে । মার্কিন সৈন্যরা সরছে । সরকারি ফৌজ পিছোচ্ছে । তালিবান এগোচ্ছে । বাইডেনের ভুলের মাশুল শেষ পর্যন্ত কারা কীভাবে গুণবে , বিশ্লেষণ করলেন উত্তম দেব –
প্রবল পরাক্রমশালী আমেরিকার আফগানিস্তান নীতি তাহলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ালো ? পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতোই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন । গত মে মাস থেকে বাহিনী প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয়েছে । ২০২১ এর ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য তুলে নেবে আমেরিকা । শুধু রাজধানী কাবুলে মার্কিন দূতাবাস পাহারায় ৬৫০ জন সৈন্য মোতায়েন রাখা হবে । কমতে কমতে আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৮৬০০তে । এবার যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র,রুগ্ন,অপুষ্ট নারী-শিশু-কিশোরকে উপরে আল্লাহ তায়ালা আর নিচে তালিবানের ওয়াস্তে ছেড়ে দিয়ে বরাবরের মতো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবে এই অবশিষ্ট মার্কিন সেনা । একটা দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে কীভাবে হাত-পা ঝেড়ে ফেলতে হয় তার আরও একটি নজির আফগানিস্তানে রেখে যাচ্ছে আমেরিকা ।
অন্যকে নষ্ট করাই আমেরিকার কাজ
২০০১ এর ৭ নভেম্বর আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী কাকে ধ্বংস করার জন্য আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল ? কুড়ি বছর পর সেই অভিযানে যখন পাকাপাকিভাবে দাঁড়ি টানতে যাচ্ছে আমেরিকা , তখন কার আস্ফালনে আফগানিস্তানের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত ? আজকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী যত সরছে ততই জাঁকিয়ে বসছে তালিবান । আফগানিস্তান জুড়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালিবানদের তুমুল যুদ্ধ চলছে । রোজ তালিবানের কাছে জমি হারাচ্ছে কাবুলে ক্ষমতাসীন সরকার । ইতিমধ্যেই ৩৪ টি প্রদেশের ৪৬০ টি জেলার মধ্যে ৩০০টিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে নিয়েছে তালিবান যোদ্ধারা । তালিবানদের এই অগ্রগতি এখন নীরব দর্শক হয়ে উপভোগ করছে ওয়াশিংটন প্রশাসন। মার্কিন সৈন্যরা বাঁধাছাদায় ব্যস্ত । তাদের ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরিয়ে আনাই জো বাইডেনের একমাত্র লক্ষ্য । ৩১ আগস্টের পর থেকে কাবুলের দূতাবাসে নিজের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়া আফগানিস্তানে আমেরিকার আর কোনও কাজ নেই । আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের যা ভাবগতিক তাতে আগস্ট শেষ হওয়ার আগেই তালিবানদের হাতে কাবুলের পতন অসম্ভব কিছু নয় । অর্থাৎ ২০০১ এর ১৩ নভেম্বর যাদের কাবুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাদেরকেই আবার কাবুলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে আমেরিকান সেনা । আফগানিস্তানের এমন শোচনীয় পরিণতির জন্য কোনও অনুশোচনা নেই বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রটির ।
আসলে অন্য রাষ্ট্রকে নষ্ট করতে জুড়ি নেই আমেরিকার । গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সমৃদ্ধ ইরাককে দেউলে করে শেষে জঙ্গি আর মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছে । গদ্দাফিতে গাত্রদাহ থাকায় লিবিয়াতে অভিযান চালিয়ে গণতন্ত্রের নামে দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে আইসিস এর মতো ইসলামিক জঙ্গিদের হাতে তুলে দিয়েছে শেষতক । একই উদ্দেশ্য নিয়ে সিরিয়াকেও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে আমেরিকা । রাশিয়া আসাদের পেছনে শক্ত খুঁটি হয়ে না দাঁড়ালে এতদিনে সিরিয়াও পুরোপুরি ইসলামিক জঙ্গিদের কবলে চলে যেত ।
তালিবানের নেতার গ্রুমিং সিআইএ’র স্কুলেই
আফগানিস্তান যে আজও একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যর্থ , এর পেছনে আমেরিকার অবদান কম নয় । মস্কো সমর্থিত বাবরাক কারমাল রেজিমকে কাবুল থেকে হটাতে খুব একটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে নি ওয়াশিংটন প্রশাসন । ১৯৭৯ সাল । ঠান্ডাযুদ্ধ শেষ হতে তখনও অনেক দেরি । কমিউনিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষতিসাধনে ইসলামিক মৌলবাদীদের সঙ্গে দোস্তি পাতাতে দ্বিধা করে নি আমেরিকা । কারমালকে রক্ষা করতে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন । এরপরের ইতিহাস সবার জানা । আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা ও মস্কো সমর্থিত বাবরাক কারমালের পিডিপিএ ( পিপল’স ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান ) সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় মুজাহিদিনরা । এই মুজাহিদিন গোষ্ঠী গুলি পরিচালিত হত বিভিন্ন উপজাতিয় ওয়ার লর্ডদের দ্বারা । মুজাহিদিনদের পেছনে এসে দাঁড়ায় আমেরিকা , পাকিস্তান ও সৌদি আরব । রাশি রাশি ডলার-পেট্রোডলার উড়তে থাকে পাক-আফগান সীমান্তবর্তী মুজাহিদিন শিবির গুলিতে । বিপুল অস্ত্র জোগায় আমেরিকা । মুজাহিদিন যোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সিআইএ । সিআইএ’কে সহযোগিতা দেয় আইএসআই আর সৌদি আরবের সিক্রেট এজেন্সি জিআইডি ( General Intelligence Directorate ) । সেই সময় কাবুলে ধর্মনিরপেক্ষ পিডিপিএ সরকারের পতন ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় ঘটানো পৃথিবীর মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছেই ছিল ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদের সমতুল্য বিষয় । বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মযোদ্ধারা এসে আফগানিস্তানে ইসলামিক শাসন কায়েমের লক্ষ্যে মুজাহিদিনদের সঙ্গে যোগ দেয় । তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর এবং আলকায়দার জনক ওসামা বিন লাদেনের গ্রুমিং কিন্তু পেশোয়ারে সিআইএ- আইএসআই এর ক্লাসরুমে । সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে একটি চোখ হারিয়ে কানা হয় মোল্লা ওমর।
দশ বছরে বড় মূল্য চুকিয়ে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে সোভিয়েত ইউনিয়ন । সোভিয়েত সেনা সরে যাবার পর কাবুলে ডঃ মুহম্মদ নাজিবুল্লাহ আহমেদজাইয়ের ( ১৯৮৬ তে বারবাক কারমালকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে নাজিবুল্লাহকে পিডিপিএ সরকারের শীর্ষে বসায় মস্কো ) সরকার টিকেছিলেন মাত্র তিন বছর । ১৯৯২ এর এপ্রিলে নাজিবুল্লাহ’র পতন হয় । ততদিনে ঠান্ডাযুদ্ধ শেষ । ক্রেমলিনে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান । সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে চুরমার । একমেরু বিশ্বের একমাত্র অধীশ্বর আমেরিকা । আফগানিস্তান মুজাহিদিনদের দখলে এল বটে কিন্তু দেশটিতে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কোনও ভূমিকা পালন করল না মুজাহিদিনদের অভিভাবক আমেরিকা । ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ – আবার গৃহযুদ্ধে মেতে উঠল আফগানিস্তান । এক একটা উপজাতি গোষ্ঠীর প্রধান হয়ে বসল এক একজন যুদ্ধবাজ নেতা । এতদিন এরা ইসলাম রক্ষায় কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়েছে । এবার পরস্পরকে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করল ।
পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় তালিবানের উত্থান দেখেও দেখে নি আমেরিকা
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের সাথে সাথেই আফগানিস্তান নিয়ে আগ্রহ হারায় ওয়াশিংটন । আফগানিস্তানে অরাজকতা মেটাতে মার্কিন প্রশাসকদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না । এই সুযোগে কাবুলে একটা পুতুল সরকার বসানোর নীলনকশা প্রস্তুত করতে থাকে পাকিস্তান । পাস্তুন , তাজিক , হাজারা , উজবেকরা যখন জমি দখলের যুদ্ধে মত্ত তখন সবার চোখের আড়ালে কান্দাহারে তালিবান নামক আন্ডায় তা দিতে শুরু করে আইএসআই । তালিবান মানে ছাত্র । কিন্তু তাদের শিক্ষাটা বড় মারাত্মক । উপমহাদেশে উগ্র ও গোড়া সুন্নি ইসলামিক ভাবধারাগুলির একটিই উৎস – দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা । মোল্লা ওমরও দেওবন্দি ঘরানার । ওমর বিশ্বাস করত আফগানিস্তানে পাপি নাজিবুল্লাহর রাজত্বের অবসান হলেও প্রকৃত ইসলাম কায়েম হয় নাই । দেশের যুবকদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা দিতে ১৯৯৪ সালে কান্দাহারে তালিবান প্রতিষ্ঠা করে মোল্লা ওমর । মাত্র পঞ্চাশ জন ছাত্র নিয়ে তালিবানের যাত্রা শুরু । কয়েক মাসের মধ্যে ওমরের পাঠশালায় পড়ুয়ার সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যায় । ততদিনে মোল্লা ওমর আইএসআইয়ের নেকনজরে । পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনী তালিবানকে মেজেঘষে মিলিশিয়া বাহিনীতে পরিণত করতে উঠেপড়ে লাগে । অস্ত্রশস্ত্র-প্রশিক্ষণ এমনকি লোকবল নিয়োগ বাদ যায় না কোনোটাই । কান্দাহারের দুর্গম এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র আফিম ক্ষেত । আন্তর্জাতিক বাজারে মাদক পাচার দ্বারা জলের স্রোতের মতো আসতে থাকল কাঁচা পয়সা । আইএসআইকে পায় কে । ধনে-জনে-রসদে তালিবানের পাশে দাঁড়িয়ে গেল পাকিস্তান । তালিবানরা যখন যুদ্ধ শুরু করল তখন ৮০ হাজার পাকিস্তানি যোদ্ধা তাদের সাহায্য করল । এদের একটা বড় অংশ ছিল পাকিস্তানের রেগুলার আর্মি । কেউ কেউ অবসরে যাওয়া ফৌজি । কেউ ভাড়াটে সৈনিক । কেউ বা জঙ্গি । দুর্ধর্ষ তাজিক কমান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদ প্রাণপণ চেষ্টার পরেও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট তালিবানকে রুখতে ব্যর্থ হলেন । ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাবুল দখল করল তালিবান যোদ্ধারা ।
আফগানিস্তান দখল করেই কাবুল থেকে রাজধানী সরিয়ে কান্দাহারে নিয়ে আসে মোল্লা ওমর । এরপর দেশে সহিহ ইসলাম কায়েমে নেমে পড়ে ওমর । স্কুল-কলেজ- ইউনিভার্সিটি তুলে দেওয়া হয় । নারী শিক্ষা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় । নাচ-গান-বাজনা হারাম ঘোষিত হয় । সিনেমা হলে তালা ঝোলে । টেলিভিশন উঠিয়ে দেওয়া হয় । ছবি তোলা নিষিদ্ধ হয় । এমনকি সেলুনের অস্তিত্বও ইসলামের জন্য বিপজ্জনক বলে গণ্য হয় । ক্ষৌরকাররা কাজ হারায় । পুরুষ মাত্রেই লম্বা দাড়ি রাখতে বাধ্য হয় । অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর চরম জুলুমবাজি শুরু হয় আফগানিস্তান জুড়ে । পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নেয় অনেক শিখ । বামিয়ানে গান্ধার যুগের সমস্ত বুদ্ধমূর্তি ও নিদর্শন কামানের গোলা মেরে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় তালিবানরা । পাকিস্তানের মদতে তালিবানের কাবুল দখল , তালিবানি রাজত্বে আফগানিস্তানে মধ্যযুগের আঁধার নেমে আসা – সবকিছুই চুপচাপ দেখে যায় আমেরিকা । আমেরিকা হীনস্বার্থে অন্ধ হয়েছিল সেদিন । কিন্তু অন্ধের জন্য তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না । অচিরেই মোল্লা ওমরের আতিথ্য গ্রহণ করে আফগানিস্তানে ডেরা বাঁধে ওসামা বিন লাদেন । আফগানিস্তান হয়ে ওঠে আল কায়দার সদর দফতর । তোড়াবোড়ার দুর্গম গুহায় বসে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক চালাতে থাকে লাদেন । তালিবান নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের টনক যখন নড়ল তখন আমেরিকার অহমিকা টুইন টাওয়ার পুড়ে ছাই । পেন্টাগনে প্রতিরক্ষা দফতর আক্রান্ত। ভয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ পরমাণু বোমা প্রতিরোধী বাঙ্কারে ।
তালিবানকে জিইয়ে রাখার দায় এড়াতে পারে না আমেরিকা
২০০১ এর নাইন ইলেভেনে আল কায়দার অকল্পনীয় হামলায় দুনিয়ার সামনে বেইজ্জতি না হলে আমেরিকা কোনও দিন আফগানিস্তানে তালিবান ঠ্যাঙাতে নামত বলে মনে হয় না । ওসামা বিন লাদেন , মোল্লা ওমর – একদিন যাদের কোলে পিঠে চড়িয়ে লায়েক বানিয়েছে সিআইএ তাদের হাতেই অবশেষে আক্রান্ত হতে হল আমেরিকাকে । ইতিহাসের পরিহাস একেই বোধ হয় বলে । টুইন টাওয়ারে জোড়া বিমানের হামলা হল ১১ সেপ্টেম্বর । আফগানিস্তানে ন্যাটোর সামরিক অভিযানের সূত্রপাত ৭ অক্টোবর । বিমান থেকে কার্পেট বোম্বিং করে করে তালিবানের মাজা ভেঙে দেওয়ার পর স্থলযুদ্ধ শুরু করে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী । ২০০১ এর ১৩ নভেম্বর কাবুল ছেড়ে পালায় তালিবানরা । ডিসেম্বরের শুরুতেই রাজধানী কান্দাহার হারায় তারা । মোল্লা ওমর বেপাত্তা হয়ে যায় । তোড়াবোড়ার গুহা ছেড়ে লাদেন আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে । মার্কিন সৈন্যরা যখন তালিবান বিরোধী আফগান গোষ্ঠী গুলির জোটকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করছিল তখনও ২৮ থেকে ৩০ হাজার পাকিস্তানি যোদ্ধা তালিবানের পাশে ছিল ।
বিশ বছর ধরে কাবুল তালিবানের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত । কাবুল – কান্দাহার হাত ছাড়া হওয়ার পর গত দুই দশকে তালিবানের শক্তি কখনও কমেছে কখনও বেড়েছে কিন্তু অন্ধকারের এই শক্তি একেবারে নির্মূল হয় নি । দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সংযোগস্থল আফগানিস্তান একটি ভূ-বেষ্টিত রাষ্ট্র ( landlocked country ) । দুর্গম গিরিরাজ্য বলতে যা বোঝায় আফগানিস্তান ঠিক তাই । পাশে পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশি । পাকিস্তানের মতো রাহু পড়শী থাকলে কোনও দেশের বালা-মুসিবত কখনও কাটে না । তালিবান হল আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাকিস্তানের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক প্রকল্প । তালিবান বিরোধী আফগানিস্তানের প্রতিটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর চোখেই পাকিস্তান দুশমন ছাড়া আর কিছু নয় । পাক-আফগান সীমান্তবর্তী নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে আফগানিস্তানে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা , নাশকতা , সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন সবসময় চালিয়ে গেছে তালিবান । ন্যাটো বাহিনীর সমর্থন থাকায় এতদিন তালিবানের হামলা সামাল দিয়ে রাজধানী কাবুল সহ আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে সরকারি সেনা । তালিবান মুক্ত আফগানিস্তানে একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা , সাংবিধানিক শাসন , খানিকটা গণতন্ত্র এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আনার চেষ্টা চলেছে এই বিশ বছরে । গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চল গুলির মধ্যে অন্যতম । নারী ও শিশুদের দুর্দশা অবর্ণনীয় । আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি , সামাজিক প্রগতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপনের সবথেকে বড় দায় আমেরিকার । কিন্তু আমেরিকা নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝে না । রহস্যজনকভাবে আমেরিকা যে কোনও সমস্যা জিইয়ে রাখতে ভালবাসে । প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর থেকে তালিবান গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ । আমেরিকা চাইলে সাম দাম দন্ড ভেদ নীতি ব্যবহার করে তালিবানের শক্তিকে অকেজো করে দিতে পারত । তালিবানের পাওয়ার হাউজের নাম পাকিস্তান । পাকিস্তানের প্রশাসনকে চালনা করে যে ডিপ স্টেট তার নাড়ি-নক্ষত্র ওয়াশিংটনের নখদর্পণে । তারপরেও আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার দীর্ঘ দুই দশকে তালিবান থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হল – এই ন্যারেটিভ হজম হওয়া শক্ত । মোদ্দা কথা হল সেই চেষ্টাই করে নি আমেরিকা ।
তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান হবে চিন-পাকিস্তানের পলিটিক্যাল হাব
আজকে তালিবান নামক হিংস্র নেকড়ের মুখের সামনে আফগানিস্তানের সেই মানুষদের ফেলে পালাচ্ছে আমেরিকা, যারা মুক্ত আলোর নীচে একটু শান্তিতে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করে প্রগতির সাথে পা মিলিয়ে চলতে ভালবাসে । তালিবান নামটা আফগানিস্তানের মেয়েদের কাছে একটা আতঙ্ক । দিকে দিকে তালিবানের বিজয়বার্তা যত ঘোষিত হচ্ছে নারী সমাজ ততই ভয়ে ত্রস্ত হয়ে উঠছে । কাবুলের নারীরা তালিবান প্রতিরোধে হাতে অস্ত্র পর্যন্ত তুলে নিতে শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে । তালিবানের অধীনে জীবনযাপন তাদের কাছে মৃত্যুর নামান্তর । যেই রাতে কাবুল ফের তালিবানের মুঠোয় চলে আসবে সেই রাতে ইসলামাবাদে জশম হবে । খুশি হবে বেজিংও । কারণ তালিবানের নতুন মিত্রর নাম চিন । দুনিয়াতে যত ‘ রিপ্রেসিভ রেজিম ‘ আছে , তাদের রক্ষা করা এখন চিনের কূটনৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে । আর যেখানে ভারতের কূটনৈতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে সেখানে অস্থিরতা তৈরিতে তো চিনের উৎসাহের শেষ নেই । আফগানিস্তানে তালিবানের রাজত্ব পুনরায় কায়েম হলে সঙ্গত কারণেই সবথেকে বেশি অসুবিধায় পড়বে ভারত । এবার তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান পরিণত হবে চিন-পাকিস্তান জোটের পলিটিক্যাল হাবে ।
তালিবান মুক্ত আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই । পাকিস্তানের বিষদৃষ্টি থেকে বাঁচতে ভারতের ওপরেই ভরসা আফগান সরকারের । গত দুই দশকে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের বন্ধুত্ব যতটা দৃঢ় হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্বের ব্যবধান হয়েছে ততটাই বিরাট । বিশ বছরে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে প্রচুর অর্থ ঢেলেছে ভারত। অনেক স্কুল-কলেজ- হাসপাতাল বানিয়ে দিয়েছে । সড়ক-সেতু নির্মাণ সহ একাধিক পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে । ভারতীয় পুঁজির বিনিয়োগ বেড়েছে সেখানে । আফগানিস্তানের আর্মিকে সামরিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণও দিয়েছে ভারত । সাউথ ব্লক জানে আফগানিস্তানে মৌলবাদী শক্তির পুনরুত্থান ভারতের নিরাপত্তার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ । জো বাইডেনের আফগানিস্তান নীতি শুধু সেই দেশের তালিবান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলিকেই বিপন্নতার মধ্যে ঠেলল না ভারতকেও বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলল ।
Photo Credits – saltoaldia.com.uy , voa , www.nbcnews.com
ভীষণ ভালো তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। কিন্ত ছবিটা ভয়ানক ও করুণ।।