বিশেষ প্রতিবেদন : বিশে যখন করোনার প্রথম ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়ল তখন দেশের বিশাল গ্রামাঞ্চল মোটের ওপর সংক্রমণ মুক্ত ছিল । করোনা শহুরে জীবনের রোগ গ্রামের নির্মল বাতাসে কোভিড নাইন্টিন ভাইরাস বিশেষ সুবিধা করতে পারে না – সামাজিক মাধ্যমে এমন ন্যারেটিভ নামতে দেরি হয় নি । স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ করোনা সংক্রমণে গ্রাম-শহরের এই বিভাজনকে নিতান্তই ভ্রান্তিবিলাস বলে উপেক্ষা করলেও জনগণের বড় অংশের এই সেদিন পর্যন্ত স্থির বিশ্বাস ছিল – স্রেফ ইমিউনিটি আর বিশুদ্ধ বাতাসের জোরে করোনাকে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম গ্রামের মানুষ । হয়তো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের চাইতে জনমতের দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিল দেশের সরকারও । তাই গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা অপেক্ষা মিথের ওপরেই আস্থা রেখেছিল প্রশাসন । এই দেশের সার্বিকভাবে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর গ্রামীণ স্তরের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না । এই পরিস্থিতিতে সুবিশাল গ্রামীণ ভারত করোনা প্যান্ডেমিকের কবলে পড়লে ক্ষতির পাল্লা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তা ভাবতেও শিউড়ে উঠছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ।
একুশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ কবে শীর্ষে পৌঁছাবে আর কবেই বা সংক্রমণের গতি শ্লথ হবে কেউ তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না । কিন্তু ইতিমধ্যেই গ্রামীণ ভারতে দ্রুত থাবা বিস্তার করতে শুরু করে দিয়েছে কোভিড ভাইরাস । উত্তরপ্রদেশ , মধ্যপ্রদেশ , রাজস্থান , মহারাষ্ট্র , ছত্তীসগঢ় এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে । দেশের বড় বড় শহর , মেগাসিটি ছাড়িয়ে ছোট ছোট শহর গুলোতে করোনার সংক্রমণ প্রথম থেকেই শনাক্ত হচ্ছিল । তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বড় শহর – ছোট শহর , নগরভারত – গ্রামীণ ভারত নির্বিশেষে একই রকম ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা । সাময়িক একটু আশার কথা হল , গত ২৪ ঘন্টায় দেশে সংক্রমণের হার দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় কমেছে । দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা সোয়া চার লক্ষে পৌঁছে গিয়েছিল । কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১২ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে নতুন করে অ্যাক্টিভ কেস শনাক্ত হয়েছে ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪২১ টি । যদিও মৃত্যু হয়েছে চার হাজারের ওপরে ( ৪২০৫ ) ! দেশে সংক্রমণের হার ৭.৫৯ শতাংশ । সংক্রমণের সরকারি পরিসংখ্যান আর বাস্তবে সংক্রমণ কতটা ছড়িয়েছে তা নিয়ে ধন্ধে সবাই । প্রকৃত অবস্থা যে সরকারি পরিসংখ্যানের চাইতে অনেক খারাপ সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের । বিহারের বক্সার , উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরে গঙ্গাবক্ষে অনেক গলিত শব ভেসে আসার ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল । করোনায় মৃতের লাশ সৎকার না করে গোপনে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে , এমন কথা চাউর হয়ে গেছে সর্বত্র । ঘটনা সত্যি না মিথ্যা তা অনুসন্ধান সাপেক্ষ । তবে ভারতের মতো বিশাল দেশে মহামারী যখন গ্রামীণ জনপদ গুলিতে পৌঁছে যায় তখন এই ধরণের দৃশ্য কিন্তু বিরল নয় ।
দেশের গ্রামাঞ্চলে না আছে কোভিড টেস্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না আছে টেস্ট করাতে মানুষের আগ্রহ । |
নগর ছাড়িয়ে আধুনিক ভারত যত গ্রামের দিকে ধাবিত হয় ততই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের ব্যবধান বাড়তে থাকে । করোনা প্যান্ডেমিকের ক্ষেত্রেও এই সংশয় উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা । কোন তথ্য-উপাত্ত , ঐতিহ্য , অভিজ্ঞতা অথবা গবেষণার ওপর আস্থা রেখে আমরা নিশ্চিন্তে বসেছিলাম যে গ্রামের মানুষ করোনা প্রতিরোধী ? একশো বছর আগে এক কোটি আশি লক্ষ ভারতবাসীর প্রাণ নিয়েছিল স্প্যানিস ফ্লু । যা তৎকালীন ভারতের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ । ১৯১৮ থেকে ১৯২১ এর মধ্যে দেশে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল স্প্যানিস ফ্লুতে । শবে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল গঙ্গা নদী । এখনও পর্যন্ত দেশে মোট করোনা সংক্রমিত ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৯৩৮ জন । মৃত্যু হয়েছে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ১৯৭ জন মানুষের । ১২ এপ্রিল পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৩০ কোটি ৭৫ লক্ষ ৮৩ হাজার ৯৯১ জনের । আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যে সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানের থেকে কয়েক গুণ বেশি এ নিয়ে সংশয় নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মহল কারোরই । রোগ চিহ্নিত হওয়ার আগেই রোগীর মৃত্যু – দেশের গ্রাম গুলিতে একটি সাধারণ ঘটনা । প্যান্ডেমিক পিরিয়ডে যা কোভিড নিয়ন্ত্রণে সরকারের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। করোনার মতো উপসর্গ কিন্তু রোগ শনাক্ত হচ্ছে না। টেস্ট করাতে রোগীরও গরজ নেই , পরিবারের লোকেরও তাগিদ নেই । এমন ঘটনা কিন্তু গ্রামাঞ্চলে ঘটতে শুরু করেছে । করোনা জনিত মৃত্যুর বহু ঘটনাও এই ভাবেই প্রশাসনের চোখের অন্তরালে ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ভারতে ।
বিহার-ইউপিতে গঙ্গায় অনেক লাশ ভাসতে দেখা গেছে । কোভিডে মৃতদের দেহই কি ফেলা হচ্ছে নদীতে । |
এই মুহুর্তে দেশের কোনও একটি জনপদ করোনা মুক্ত নয় বলে নিশ্চিত খোদ সরকারও । গ্রামের মানুষ শহর থেকে ভাইরাস বহন করে ফিরে গ্রামীণ জনপদে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয় । চিরকাল এমনি করেই এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে । করোনার মতো অতি সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে আশা করাটা ভাবের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয় । বরং ১৩৪ কোটি মানুষের এই বিশাল দেশ যে কোনও ভাইরাসের উর্বর আঁতুরঘর হওয়ার জন্য যথেষ্ট । এই দেশের মানুষের দেহকে আশ্রয় করে থাকতে থাকতেই করোনা ভাইরাস নিজের রূপ পাল্টে ডেডলি ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়ান্টের জন্ম দিয়ে ফেলেছে । B.1.617 নামাঙ্কিত কোভিডের এই ভারতীয় প্রজাতি ব্রিটেন , দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে মিউটেট হওয়া কোভিড স্ট্রেনের থেকে অনেক বেশি সংক্রমক বলে মেনে নিয়েছেন সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা । গ্রামীণ জনজীবনে কোভিড বিধ্বংসী রূপ নেওয়ার আগেই উপযুক্ত পদক্ষেপ জরুরী বলেই মনে করছেন চিকিৎসকেরা ।
Photo Credits – economictimes.com , newsclick.com / AFP , twitter.