উত্তম দেব
অবশেষে আট দফায় পশ্চিমবঙ্গের সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচন শেষ হতে চলেছে আজ বৃহস্পতিবার ২০২১ এর ২৯ এপ্রিল । প্রথম দফার ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছিল ২৭ মার্চ । ভোটগ্রহণ পর্ব মিটতেই এক মাস কাবার ! এই একমাসে চারজন প্রার্থীর মৃত্যু হল করোনায় । ভোট নেওয়ার আগেই দুটি কেন্দ্রে প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় স্থগিত হয়ে যাওয়া ওই দুটি কেন্দ্রে নতুন ঘোষিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ভোট হবে আগামী ১৬ মে । ভোট হয়ে যাওয়ার পর একটি কেন্দ্রে প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় গণনা হবে যথারীতি । প্রয়াত প্রার্থী বিজয়ী হলে কেন্দ্রটিতে উপনির্বাচন হবে বিধি মেনে । একটি কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থীর মৃত্যু হয়েছে । যেহেতু নির্দল প্রার্থীর মৃত্যুতে এখন আর ভোট স্থগিত হয় না , তাই সেই কেন্দ্রে অষ্টম দফায় ভোট চলছে যথারীতি । চার প্রার্থীরই মৃত্যু হয়েছে কালান্তক করোনায় ।
প্যান্ডেমিক পিরিয়ডে ভোট করতে গিয়ে শেষ বেলায় এসে নাস্তানাবুদ নির্বাচন কমিশন , কতকটা কমিশনের নিজের দোষে কতকটা পরিস্থিতির চাপে । নির্বাচন কালে করোনার সংক্রমণ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় কমিশনের দিকেই আঙ্গুল তুলেছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট । যদিও পশ্চিমবঙ্গ বাদে বাকি তিন রাজ্য ও একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ২৭ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ভোট গ্রহণ পর্ব ৬ এপ্রিলের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে । দক্ষিণের দুই রাজ্য কেরল বিধানসভার ১৪০ , তামিলনাড়ু বিধানসভার ২৩৪ ও পন্ডিচেরি বিধানসভার ৩০ টি আসনে ভোট মাত্র এক দফাতেই শেষ হয়ে গেছে গত ২৭ মার্চ । আসাম বিধানসভার ১২৬ টি আসনে তিনটি দফায় ভোট নেওয়া হয়েছে ২৭ মার্চ , ১ এপ্রিল ও ৬ এপ্রিল । প্যান্ডেমিকের মধ্যেই গত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিহার বিধানসভার ২৪৩ আসনে হাই ভোল্টেজ নির্বাচন সবার আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে মাত্র তিন দফায় ।
রাজনৈতিক নেতাদের উষ্মায় কিছু যায়-আসে না। কেন্দ্রীয় বাহিনী বুথে মোতায়েন থাকলে ভরসা পান সাধারণ মানুষ । |
বিহারে যখন ভোট হল তখনও কোভিডের কথা মাথায় রেখে কিছু নির্দেশিকা দিয়েছিল কমিশন । যদিও প্রচারপর্বে তা থোরাই মেনে চলেছিল রাজনৈতিক দল গুলো । অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে করোনার গ্রাফটা বেশ নিম্নমুখী থাকায় বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে করোনা জনিত কোনও গোল বাঁধে নি । যদিও বিহারের মতো রাজ্যে ভোট ঘিরে একটিও লাশ না পড়ার ঘটনায় রীতিমতো তাজ্জব বনে যায় দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে সংবাদ মাধ্যম সবাই । দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে মার্চ থেকেই দেশে কোভিডের সংক্রমণ বৃদ্ধি চোখে পড়তে শুরু করে । যদিও পশ্চিমবঙ্গ সহ চার রাজ্য ও একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘন্ট ফেব্রুয়ারি মাসেই সম্পূর্ণ করে ফেলে নির্বাচন কমিশন । পশ্চিমবঙ্গে চতুর্থ দফার ভোট অনুষ্ঠিত হয় ১০ এপ্রিল । পঞ্চম দফায় ১৭ এপ্রিল । চতুর্থ ও পঞ্চম দফার বিরতির মধ্যেই কোভিড সারা দেশে ফের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াল । পশ্চিমবঙ্গে তখন রমরমিয়ে ভোটের প্রচার চলছে । আদালতের ভর্ৎসনার মুখে কমিশন যখন প্রচারে লাগাম টানল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে ।
কোভিড বিধি কার্যকর করা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ঢিলেমি অবশ্যই নিন্দার্হ । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বহু দফা ভোট নেওয়ার জন্য যারা কমিশনের শ্রাদ্ধ করছেন তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বোধ-বুদ্ধি নিয়ে আমার বেশ সংশয় আছে । শাসক দলের একদফায় ভোট চাওয়ার আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে কিছু বলার নেই । আজ বহু দফায় ভোট ও ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের মুন্ডুপাত করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন । ২০১৪ ও ২০১৬ র নির্বাচনেও কমিশনের এই দুটি কাজ তৃণমূল সুপ্রিমোকে নাখোশ করেছিল । এবং ২০১১ র পর থেকে প্রত্যেকটি নির্বাচনেই বিরোধীদের পাশাপাশি কমিশনকেও প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলাটা মমতার একটা রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে । অথচ ২০১১র আগে রাজ্যে বহু দফায় ভোট ও প্রত্যেক বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন – এই দুটির সবথেকে বড় দাবিদার ছিলেন যে মানুষটি তাঁর নামও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
কে বলতে পারে আজকে যিনি রোষে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে দলের কর্মীদের তাতাচ্ছেন তিন বছর পরে তাঁকেই প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন তদুপরি আট দফা ভোটের দাবিতে কমিশনের দরজায় ধর্নায় বসতে দেখা যাবে না ? ‘ চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায় ‘ – রাতে শুতে যাবার আগে রোজ একবার করে নজরুলের গানটা শোনা উচিত নেতানেত্রীদের ।
পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ এর বিধানসভা নির্বাচন ১৭ এপ্রিল থেকে ৮ মের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মোট পাঁচ দফায় । ২০১১র বিধানসভা নির্বাচনে ১৮ এপ্রিল থেকে ১০ মের মধ্যে ভোট নেওয়া হয়েছিল মোট ছয় দফায় । ২০১৬র বিধানসভা নির্বাচনে ৪ এপ্রিল থেকে ৫ মের মধ্যে ভোট গ্রহণ হয়েছিল মোট ছয় দফায় । ২০০৬ এবং ২০১১ র বহু দফার ভোট তৃণমূলের কাছে মিঠা লাগলেও ২০১৬টার লেগেছিল তিতা । এর নামই রাজনীতি ! বাংলায় ২০১৮র পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪ মে । ১৪ ও ১৫ মে – এই দুই দিনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার বলি হন ২৫টি মানুষ । পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব থেকে ভোটগ্রহণ এমনকি ভোটগণনা ঘিরে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা বাংলায় ঘটে গিয়েছে তার স্মৃতি কিন্তু মানুষের মন থেকে এখনও মুছে যায় নি । নির্বাচন পরিচালনার সময় প্রত্যেকটি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হয় নির্বাচন কমিশনকে । এই ব্যাপারে আমাদের রাজ্যের ট্র্যাক রেকর্ডস এত চমৎকার যে পশ্চিমবঙ্গে যেকোনও ভোটের নির্ঘন্ট প্রকাশের আগে একশ বার ভাবতে হয় কমিশনের আধিকারিকদের ।
যে ভোট মাত্র দুই-তিন দফায় সেরে ফেলা সম্ভব তা আট-দশ দফা পর্যন্ত গড়ানো নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত । এর ফলে সময় এবং অর্থের বিপুল অপচয় হয় । মানুষের প্রাণের চেয়ে ভোটের দাম বেশি নয় – বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে এই যুক্তিতে যারা এক-দুই দফায় ভোট না করায় নির্বাচন কমিশনের সমালোচনায় ব্যস্ত সেই একই যুক্তিতে কিন্তু বিপুল খরচ ও ঝামেলা জেনেও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক হিংসাদীর্ণ রাজ্যে আট দফায় ভোট করতে বাধ্য হয়েছে কমিশন । পশ্চিমবঙ্গে যে নজিরবিহীন কড়াকড়ির মধ্যে আট দফার ভোট মিটতে চলেছে এর ব্যতিক্রম ঘটলে ময়নাতদন্তের জন্য কতগুলো লাশ মর্গে পাঠাতে হত পুলিশেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে তা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় আমাদের ।
শেষ দফার ভোটে মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর বিধানসভা কেন্দ্রের একটি বুথে ভোট গ্রহণের চিত্র । |
মাসাধিক কাল ধরে আট দফার ভোট । অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশের প্রতি নাগরিকদের অনাস্থা । বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রতিটি বুথে সাত-আটজন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান মোতায়েন করে তবে নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারা । এর সমস্ত কিছুই পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে আমাদের লজ্জার । এই লজ্জার দায় নিজেদের ঘাড়ে না নিয়ে কমিশনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আরও বেশি লজ্জার । এই লজ্জার হাত থেকে পরিত্রাণের একটিই উপায় – ব্লেম গেম বন্ধ করে রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংশোধনে সমবেত উদ্যোগ গ্রহণ । এর বাইরে গিয়ে যে কোনও ধরণের আত্মছলনার আশ্রয় নিলে লিখে নিন ২০২৪ এর লোকসভা এবং ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচনেও শতভাগ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েনে বহুদফা ভোটের ট্র্যাডিশন থেকে মুক্তি পাবে না পশ্চিমবঙ্গ । কে বলতে পারে আজকে যিনি রোষে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে দলের কর্মীদের তাতাচ্ছেন তিন বছর পরে তাঁকেই প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন তদুপরি আট দফা ভোটের দাবিতে কমিশনের দরজায় ধর্নায় বসতে দেখা যাবে না ? ‘ চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায় ‘ – রাতে শুতে যাবার আগে রোজ একবার করে নজরুলের গানটা শোনা উচিত নেতানেত্রীদের ।
Pictures Credits – ECI and CRPF official FB page.