উ ত্ত ম দে ব
কাশী বিদ্যাপীঠে পড়তে পড়তেই মহাত্মাজির ডাকে সাড়া দিয়ে পিকেটিং করতে পথে নেমেছিল উন্নাওয়ের এক কিশোর । তখন ১৯২১ । অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল ব্রিটিশ ভারতবর্ষ । সত্যাগ্রহ করে গ্রেফতার হল বছর পনেরোর সেই কিশোর। কিশোর সত্যাগ্রহীকে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করলেন – তোমার নাম কী ? ছোটখাটো গোলগাল চেহারার কিশোর উত্তর দিল – আজাদ । পিতার নাম ? উত্তর এল –আজাদ । সাকিন ? কিশোরটির জবাব – জেলখানা । রুষ্ট হাকিম হুকুম দিল এই বেয়াদবকে বেত মারো । পনেরোর বছরের কিশোরের শাস্তি জুটল পনেরোটি বেত্রাঘাত ! টিকটিকিতে হাত-পা বেঁধে কিশোরটির শরীরে গুনে গুনে পনেরো বার বেত মারল সিপাই । হাওয়ায় হিসহিস শব্দে তুলে এক- একেকটি বেত দেহে এসে আঘাত করতেই কিশোরটি চিৎকার করে বলছে ‘মহাত্মাজি কি জয় ‘। পনেরোটি বাড়ি । পনেরোবার গান্ধীর নামে জয়ধ্বনি । কিশোরটির পিতৃদত্ত নাম চন্দ্রশেখর । পদবি তিওয়ারি । কিন্তু সেদিন থেকেই চন্দ্রশেখর হয়ে গেল ‘ আজাদ ‘ । ইতিহাস তাঁকে চেনে চন্দ্রশেখর আজাদ নামেই ।
ভারতের কিংবদন্তি বিপ্লবীদের অন্যতম চন্দ্রশেখর আজাদ । যিনি সহযোদ্ধাদের গর্ব করে বলতেন – ‘ আজাদ ছিলাম । আজাদ আছি । আজাদ হয়েই মরব । ‘ পঁচিশ বছরের নাতিদীর্ঘ বিপ্লবী জীবনে চন্দ্রশেখর আজাদকে কখনও ইংরেজের জেলখানায় বন্দী হয়ে কাটাতে হয় নি । ১৯৩১ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে এলাহাবাদের অ্যালফ্রেড পার্কে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন আজাদ । গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ‘ মাউজার ‘ পিস্তলের নলটি নিজের মাথায় ঠেকিয়ে শেষ বুলেটটি খরচ করেন চন্দ্রশেখর আজাদ । ইংরেজের পুলিশ যখন তাঁকে ছুঁতে পেল তখন আজাদ ‘ লাশ ‘ মাত্র । চন্দ্রশেখর তিওয়ারির প্রাণপাখি ততক্ষণে চির আজাদ হয়ে ইংরেজের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ।
ব্রাহ্মণ পন্ডিত বংশের ছেলে । মা জাগ্রাণী দেবী চেয়েছিলেন বড় হয়ে ছেলে হবে মস্ত বড় পন্ডিত । কিন্তু ছেলে ভিড়ল গিয়ে বিপ্লবীদের দলে । কাশী বিদ্যাপীঠে পড়তে পড়তেই বয়স ষোলো পেরোনোর আগেই বিপ্লবী মন্মথনাথ গুপ্তার সৌজন্যে রামপ্রসাদ বিসমিলের সঙ্গে পরিচয় । ‘ হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের ‘ অন্যতম সংগঠক রামপ্রসাদ বিসমিলের হাত ধরেই চন্দ্রশেখর আজাদের বিপ্লবী জীবনের সূত্রপাত । ১৯২৫ এ ইতিহাস বিখ্যাত কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলায় যখন নাম উঠল তখন আজাদের বয়স মাত্র ঊনিশ । উত্তরপ্রদেশের কাকোরীর কাছে ট্রেন থামিয়ে সরকারি টাকা লুঠ করেছিলেন এইচআরএ’ র বিপ্লবীরা । সেই দলে ছিলেন চন্দ্রশেখর আজাদও । দলের সবাই ধরা পড়লেও আজাদের নাগাল পায় নি পুলিশ । কাকোরী কান্ডের পর পুলিশের ধরপাকড়ে ‘ হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের ‘ সংগঠন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । ধীরে ধীরে আবার নিজেদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন ফেরার বিপ্লবীরা । সংগঠনের হাল ধরেন চন্দ্রশেখর আজাদ । সামনে এগিয়ে আসেন ভগৎ সিং । ১৯২৮ এর ৮-৯ সেপ্টেম্বর দিল্লির কাছে ফিরোজ শাহ কোটলায় মিলিত হন বাংলা , পাঞ্জাব , বিহার এবং যুক্তপ্রদেশের বিপ্লবীরা । দলের নামের সঙ্গে সোস্যালিস্ট যুক্ত করে রাখা হয় ‘ হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন ‘ ।
আজাদের একমাত্র ফটো ও তাঁর ব্যবহৃত পিস্তল |
‘ হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের ‘ ছত্রছায়ায় পুনর্সংগঠিত হওয়ার পর বিপ্লবীদের বড় অ্যাকশন ছিল জাতীয়তাবাদী নেতা লালা লাজপত রাইয়ের ওপর নির্যাতনের বদলা নেওয়া । ১৯২৮ এর ৩০ অক্টোবর লাহোরের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ জন পি স্যান্ডার্সকে গুলি করে খুন করেন বিপ্লবীদের যে দলটি তাতে ভগৎ সিং , সুখদেব এবং রাজগুরু ছাড়াও ছিলেন চন্দ্রশেখর আজাদ । ঘটনাস্থলে হেড কনস্টেবল চন্নন সিং পলায়নরত ভগৎ সিংদের পেছনে ধাওয়া করলে আড়াল থেকে চন্নন সিংকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন আজাদ ।
এইচএসআরএ‘ র পরবর্তী অভিযান ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা । ১৯২৯ এর ৮ এপ্রিল সরকারের ট্রেড ডিসপিউট বিলের প্রতিবাদে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় আইনসভায় ধোঁয়া বোমা নিক্ষেপ । ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দর্শক গ্যালারি থেকে হাউসের ফ্লোরে বোমা ছুঁড়ে চারদিকে ছিটিয়ে দেন লাল ইস্তেহার । পালিয়ে না গিয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলতে বলতে স্বেচ্ছায় ধরা দেন দুই বিপ্লবী । ইশতেহারে বড় বড় করে লেখা ছিল ‘ বধিরকে শোনাতে হলে জোরে আওয়াজ করতে হয় । ‘ এই ঘটনার অভিঘাতে উথালপাথাল হয়ে যায় গোটা দেশ । ইংরেজের অহমিকা চুপসে দেয় কয়েকজন অকুতোভয় ভারতীয় যুবক । বিপ্লবীদের কোমড় ভাঙতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সরকার । লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় স্যান্ডার্স খুনের দায়ে ১৯৩১ এর ২৩ মার্চ ফাঁসি হয় বিপ্লবীত্রয় ভগৎ সিং, সুখদেব , রাজগুরুর । কিন্তু মামলার অন্যতম আসামী হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের কমান্ডার ইন চিফ চন্দ্রশেখর আজাদের টিকি পর্যন্ত ছুঁতে ব্যর্থ ব্রিটিশ পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দারা । আটাশের ৩০ অক্টোবর থেকে আজাদের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে পুলিশ । একে একে ধরা পড়তে থাকেন সহযোদ্ধারা । কিন্তু আজাদ আজাদই থাকেন । বিপ্লবী শিব বর্মা তাঁর ‘ শহীদ স্মৃতি ‘ গ্রন্থে লিখেছেন , ‘ পূর্বে যখন আজাদকে পন্ডিতজি বলে সম্বোধন করে বলতাম যে তাঁকে ঝোলাতে মোটা রশি লাগবে , তখন সে নিজের পিস্তল ধরে বলত ‘ এটা থাকা পর্যন্ত কারও মুরোদ নেই যে জীবিত পন্ডিতজির শরীর স্পর্শ করে । ‘
এনকাউন্টার স্থলে শহিদ চন্দ্রশেখর আজাদের নিথর দেহ |
পন্ডিতজির জীবিত শরীর ইংরেজের পুলিশ স্পর্শ করতে পারে নি । চন্দ্রশেখরের কব্জিতে পরানোর মতো কোনও হ্যান্ডকাপ তৈরি করতে পারে নি ইংরেজ সরকার । ১৯৩১ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি এলাহাবাদের অ্যালফ্রেড পার্কে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে লড়তে লড়তে প্রাণ দিলেন বছর পঁচিশের চন্দ্রশেখর ‘আজাদ ‘। গাছের আড়ালে লুটিয়ে পড়ল নিথর দেহ । আজাদের রক্ত শুষে নিল দেশের মাটি । স্বাধীনতার পর অ্যালফ্রেড মুছে দিয়ে পার্কটির নাম রাখা হয় ‘ আজাদ পার্ক ‘ ।