উত্তম দেব
মহুয়া মৈত্র যোগ্য সাংসদ কিন্তু স্বভাবে দুর্বিনীত । খুব সম্ভবত নিজের বিদ্যা , বুদ্ধি , রূপ , গুণ আর সামাজিক অবস্থানের গৌরবে তিনি দিবানিশি বেলুনের ন্যায় স্ফীত থাকেন । বাংলার সাংবাদিক মহল তাঁর উপর বেজায় রেগেছে । রাগ এখনও কমেছে কিনা জানি না । কারণ সাংবাদিকদের রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না । বিত্ত , বর্ণ , ধর্ম , শ্রেণী, গাত্রচর্ম , চেহারা কিম্বা পেশা যার যাই হোক না কেন মানুষ হয়ে মানুষকে অপমান করা পাপ । কিন্তু ক’জন মানে ? আমরা অহর্নিশ ভাই , বন্ধু , প্রতিবেশী , সহকর্মী , সহযাত্রী , সহনাগরিককে অপমান করে থাকি । অন্যকে অপমান করে আমরা আনন্দ পাই নিজেরা অপমানিত হলে কষ্ট ।
সাংবাদিকরা পেশার খাতিরে সর্বত্রগামী । সাংবাদিকদের অনাহুত উপস্থিতিতে অনেক সময় কেউ কেউ বিরক্তিও বোধ করেন । পেশার ঠ্যালায় সাংবাদিক ও পুলিশকে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয় । একজন মানুষ যেসব বিষয় নিয়ে আরেকজন মানুষকে সবথেকে বেশি খোঁটা দিয়ে থাকে তার একটি অবশ্যই আয় জনিত । সমাজে কেউ পাঁচ লাখ কামান কেউ পাঁচ হাজার । মহুয়া ঠিক কত কামান সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই । সাংসদদের ঘোষিত রোজগার কত তা দেশের নাগরিকেরা জানে । সেটা মন্দ নয় । অনেক নেতা-জনপ্রতিনিধি-মন্ত্রীর অঘোষিত রোজগার তাঁদের ঘোষিত রোজগারের কত গুণ অধিক তা জনগণ জানতে পারে না বাতাসের গন্ধ থেকে হালকা পাতলা উপলব্ধি করতে পারে মাত্র। দৈবের বশে মহুয়া মৈত্র ধনীর দুলালী । মেধার জোরে প্রবাসে পেশাগত জীবনে তিনি শুধু ভারতীয় রূপিই নয় প্রভূত ইউএস ডলারও আয় করেছেন । মার্কিন মুলুকের উচ্চতর বেতনের চাকরি ছেড়ে স্বদেশের ধুলোবালির মধ্যে কাঙাল স্বজাতির সেবায় তিনি যে স্রেফ দয়া করে নেমে এসেছেন হাবেভাবে এটা বোঝাতে মহুয়া মৈত্র চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না ।
দু’পয়সা , চার পয়সা , চারআনা , আটআনা – এইসব শব্দ সামাজিক অবস্থানের দৈন্যতার সূচক । মহুয়া মৈত্রের কাছে সাংবাদিকরা দু’পয়সার । অর্থাৎ তিনি জানেন বাংলায় যারা সাংবাদিকতা করেন । বুম, ক্যামেরা , স্ট্যান্ড , লোগো নিয়ে নেতা মন্ত্রীদের কনভয়ের পেছনে পেছনে দৌঁড়োয় তাঁদের রোজগার পাতি ভালো নয় । যার রোজগার ভালো নয় তার আর্থ-সামাজিক অবস্থানও নড়বড়ে হতে বাধ্য । শুধু মহুয়া নয় তাঁর দলের সুপ্রিমোও সাংবাদিকদের অর্থকষ্টের কথা ভেবে তাদের কীভাবে করুণা করতে হয় তা বেশ ভালই জানেন । তাই পুজোয় সাংবাদিকদের হাজার টাকা করে বখশিশ প্রদানের কথা ঘোষণা করতেও তাঁর সরকারের বাধে না ।
সাংবাদিকরা অভিজাত নন। কোনও কালেই ছিলেন না । রাজা ষোড়শ লুইয়ের আমলেও ফরাসী সমাজে সাংবাদিকেরা ছিলেন থার্ড এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত । তবে কোনও কোনও সাংবাদিক কপাল গুণে , হাতের জোরে এবং জ্ঞাত-অজ্ঞাত নানা প্রতিভার দৌলতে সমাজে অভিজাত , সম্ভ্রান্ত এবং ধনাঢ্য হয়ে যান । কিন্তু সে তো হাতে গোনা কয়েকজন ।
মহুয়ার দু’পয়সা কটাক্ষে সাংবাদিকরা মর্মে আঘাত পেয়েছেন । বাদ-প্রতিবাদ বিস্তর হয়েছে । মহুয়ার কথায় সাংবাদিকদের মানে লেগেছে গায়ে নয় । অনেক সময় মনের ব্যথা গায়ের ব্যথার থেকে বেশি কষ্টকর হয় বৈকি । এমনিতে মাইর-মুরা-অপমান সাংবাদিকদের জীবনে নতুন কিছু নয় । ইতিপূর্বে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা কম ঘটে নাই । এক সাংবাদিক মার খেলে আরেক সাংবাদিকের দুঃখে হৃদয় ফেটে যায় এমন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাই নি । বাদ-প্রতিবাদ , বয়কটের রেজাল্ট শেষ পর্যন্ত কী হয় সাংবাদিকরাই তা সবথেকে ভালো জানেন।
সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা যা নিজের কর্মক্ষেত্রেই সবথেকে বেশি অবহেলিত , অনিশ্চিত এমনকি অত্যাচারিত বললেও ভুল নয় । মিডিয়া একটা ইন্ডাস্ট্রি । এটা চালাতে বিস্তর পুঁজি লাগে । এই ইন্ডাস্ট্রি যারা চালায় পুঁজি তারা কীভাবে সংগ্রহ করে তা সবাই জানে । এতে সাংবাদিকের মতামতের কানাকড়িও দাম থাকে না। এবং একটি মিডিয়া হাউসের মাথায় লাগানো অদৃশ্য হাওয়া মোরগ কখন কোন দিকে ঘুরবে তা নিয়েও সেই হাউসের সাংবাদিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার চার পয়সাও দাম নেই । দাম যে নেই এটা মহুয়া – মমতা – মোদী সবাই জানেন । মহুয়া ঠোঁট কাটা । মনের কথাটা মুখে উগড়ে দিয়েছেন মাত্র ।
পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা কতটা অনিশ্চিত । সংবাদকর্মীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা কত ঠুনকো তা দেখিয়ে দিলো কোভিড প্যান্ডেমিক । দীর্ঘ লকডাউন দেশের কর্পোরেট সেক্টরে , বড়-মাঝারি-ছোট শিল্পক্ষেত্রে অজস্র মানুষের কর্মচ্যুতির কারণ হয়েছে সত্যি কিন্তু মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি , এক একটি তথাকথিত বিশাল বিশাল মিডিয়া হাউজ যেভাবে সাংবাদিকদের দূর দূর করে তাড়িয়েছে তা দেখে জুটমিলের শ্রমিকরাও তাজ্জব বনে যেতে বাধ্য । একটা সাংবাদিকের চাকরি খাওয়ার জন্য ম্যানেজমেন্টের তরফে একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজই যথেষ্ট ।
আপৎকালে যে সেক্টর যত ভাল সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে কর্মীশক্তিকে অক্ষত রেখেই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় মানুষের কাছে সেই সেক্টরের দাম তত বেশি । অতিমারি কালে ভারতের মিডিয়া সেক্টর বিপদের আঁচ গায়ে এসে লাগতে না লাগতেই নিজের বিশ্বস্ত কর্মীদের ঘাড়ে ধরে দরজার বাইরে বের করে দিয়েছে । জাহাজে জল ঢোকা মাত্রই যে ক্যাপ্টেন যাত্রীদের লাথিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সেই ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেশের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের কোনও পার্থক্য নেই । ভারতের মিডিয়া সেক্টরের কোনও কর্মীবান্ধব সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি নেই ।
কেন নেই এই প্রশ্ন তোলার মতো অওকাত সাংবাদিকদের , সাংবাদিক ইউনিয়ন গুলির , বড় বড় প্রেস ক্লাবের আছে ? পাশের ডেক্সে কাজ করা সহকর্মীর চাকরি নট হয়ে যাওয়ার খবর শুনে যে পেশার লোক শনিঠাকুরকে ধন্যবাদ জানিয়ে মনে মনে বলে যাক বাবা এই যাত্রায় ম্যানেজমেন্টের কোপটা অন্যের ঘাড়ের ওপর দিয়েই গেল , সেই পেশার লোকদের ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক মহুয়া ম্যাডামের দাগা ভুলতে কতক্ষণ !