প্রদ্যুৎ দাস : এবার সরকারি চাকরি ও কর্মসংস্থানের দাবিতে সরব হলেন কেএলও জঙ্গিদের গুলিতে নিহতদের পরিজনেরা। জঙ্গি আক্রমণে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের সরকার ডেকে চাকরি দিল অথচ যারা জঙ্গিদের গুলিতে বেঘোরে মরল তাদের ছেলে মেয়েরা রইল বঞ্চিত । দীর্ঘদিন চাকরির দাবিতে সরকারের ঘরে মাথাকুটেও আশার আলো না দেখে অবশেষে প্রকাশ্যে মুখ খুললেন কেএলও জঙ্গিদের গুলিতে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা । সোমবার জলপাইগুড়ি প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে চাকরির দাবি জানালেন সাতাশটি পরিবারের সদস্যরা। এই সাতাশ জনকেই নব্বুইয়ের দশকের শেষ থেকে ২০০৩ এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে হত্যা করেছে কেএলও জঙ্গিরা ।
পৃথক রাজ্যের দাবিতে কামতাপুরি আন্দোলনকে জঙ্গি আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায় কেএলও বা কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আলফা সহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ভূটানের জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়ে কেএলও জঙ্গিরা । গত শতাব্দীর নব্বুইয়ের দশকের শেষ থেকে দু’হাজার তিনের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবিভক্ত জলপাইগুড়ির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নাশকতা চালিয়েছিল কেএলও । সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের নেতা থেকে একাধিক বাম কর্মী ও সমর্থক সহ সাতচল্লিশ জন মানুষ জঙ্গিদের বুলেটে প্রাণ দেন । ২০০৩ এর ডিসেম্বরে অসমের আলফা জঙ্গিদের শায়েস্তা করতে ভূটানের পাহাড় জঙ্গল ঘিরে অপারেশন অল ক্লিয়ার চালায় কেন্দ্রের এনডিএ সরকার । ভারতীয় সেনার পাশাপাশি ভূটানি সেনার অভিযানে জঙ্গি ঘাঁটি বিধ্বস্ত হয় । আলফার ছত্রছায়ায় থাকা কেএলও জঙ্গিদের একটা বড় অংশ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় । অনেকে ধরা পড়ে কিংবা এনকাউন্টারে মারা যায় । ধৃত জঙ্গিদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে । অনেকেই হোমগার্ড সহ বিভিন্ন দফতরে চাকরি পায় । জোটে সরকারি অনুদান এবং ব্যাঙ্ক ঋণও ।
আগের বাম সরকার থেকে বর্তমান তৃণমূল সরকারের জামানায় প্রাক্তন কেএলও জঙ্গি ও লিঙ্কম্যানদের সরকারি কর্মসংস্থান সহ অন্যান্য সুবিধা অব্যাহত থাকলেও তাদের দিকে সরকারের নজর নেই । এমনই অভিযোগ জঙ্গিদের গুলিতে নিহতদের পরিজনদের । নিহতদের মধ্যে যারা বাম কর্মী ও সমর্থক ছিলেন , এমন কুড়ি জনের পরিবার তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে চাকরি সহ অন্যান্য সুবিধা পেলেও বাকি নিহত সাতাশ জনের পরিবারের আজ পর্যন্ত কিছুই জোটে নি বলে অভিযোগ।
ময়নাগুড়ি ব্লকের জল্পেশ এলাকার যুবক শুভজিৎ সরকারের বাবা স্বপন সরকার ছিলেন ওষুধের দোকানদার। ২০০১এর ১০ অক্টোবর বিকেলে দোকানে জঙ্গিদের হামলায় স্বপনবাবু সহ দু’জন নিহত হন । একই ব্লকের বাংলার ঝাড় গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণ সরকার ২০০৩ এর ১৩ মার্চ রাতে টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে জঙ্গিদের গুলিতে আহত হয় । সেই সময় কৃষ্ণ ক্লাস নাইনে পড়ত । দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ২০০৫ এ আর এস ভি ওয়াই প্রশিক্ষণ শেষ করেও চাকরি কিম্বা অনুদান কোনটাই পায় নি কৃষ্ণ সরকার ।
জঙ্গিদের নাশকতায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের আজ একটাই প্রশ্ন, নির্বিচারে মানুষ খুন করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়েও প্রাক্তন জঙ্গি ও লিঙ্কম্যানরা চাকরি পেয়ে গেল আর আমরা জঙ্গিদের কারণে অনাথ হয়েও সরকারের সহানুভূতি পাচ্ছি না কেন ? সরকার দিনের পর দিন বধির হয়ে থাকলে তারাও আন্দোলনে নামবেন বলে সোমবার সাংবাদিকদের সামনে হুঁশিয়ারি দিলেন জঙ্গিদের গুলিতে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা ।
জঙ্গি হানায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দাবি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করছে বিজেপি। সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির ছিলেন বিজেপি যুবমোর্চার উত্তরবঙ্গের কো- কনভেনার শ্যামপ্রসাদ । শ্যামপ্রসাদ বলেন , বিপথগামী জঙ্গিদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে তাদের যেমন পুনর্বাসন জরুরী তেমনি যারা জঙ্গি নাশকতার বলি তাদের অসহায় পরিবারের দিকে দৃষ্টি দেওয়াও দরকার । ২৭টি পরিবারের সদস্যদের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে সরকারের বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন শ্যামপ্রসাদবাবু ।
ছবি-ভিডিও – নিজস্ব